বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক পঠিত রোমান্টিক বাংলা কবিতাগুলোর মধ্যে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন ‘অন্যতম। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালে কবি বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা ‘ পত্রিকায়। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত ‘বনলতা সেন ‘নামক কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে এই কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, তবে এটির রচনাকাল ছিল ১৯৩৪ সাল।
এই কবিতাটির মধ্যে পাঠকের মনে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করার মতো যথেষ্ট উপাদান রয়েছে, রয়েছে কুহকজালে আচ্ছন্ন কথামালা ও রহস্যময়ী এক নারীর প্রতি কবির গোপন-প্রেম। তবে এসব ছাপিয়ে মোট আঠারো পংক্তি নিয়ে তিনটি স্তবকের চমৎকার গঠনশৈলী চোখে পড়ে যা তাঁর প্রিয় ছন্দ অক্ষরবৃত্ত বা পয়ারে রচনা করেছেন। যদিও এতে অক্ষরবৃত্তের সূত্রহীন ব্যবহার রয়েছে তারপরেও এর সঙ্গীতময়তা ও দোলা পাঠকের মনে গভীর অনুরণন সৃষ্টি করে এবং না পাওয়ার বেদনা ও হাহাকার ছড়িয়ে দেয় হৃদয়ের গভীর প্রকোষ্ঠে। সাধু-চলিত ভাষা একইসাথে ব্যবহার করে জীবনানন্দ সমালোচকদের তীক্ষ্ণ বর্শায় আহত হয়েছেন বারবার কিন্তু তিনি থামেননি, এতে তাঁর কবিতা নতুন নতুন মাত্রা লাভ করেছে এবং চিন্তাশীল বোদ্ধা পাঠকমাত্র বুঝতে পারে যে এটি তিনি অত্যন্ত সচেতনভাবে করেছেন। কবি ছিলেন একজন উঁচুদরের পাঠক। তাঁর পড়াশুনার ব্যাপ্তি বাংলা সাহিত্য, ভূগোল, ইতিহাস, দর্শন ছাড়িয়ে বিশ্বসাহিত্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই ‘বনলতা সেন ‘কবিতায় অনেক সমালোচক আমেরিকান কবি এডগার এলেন পো এর বিখ্যাত কবিতা ‘টু হেলেন’(১৮৩১) এর ছায়া দেখতে পান ও তিনি এই কবিতাটি দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত বলে মনে করেন। ‘টু হেলেন’ কবিতার Thy classic face I Thy hyacinth hair আর কাব্যভাবনার কিছু মিল থাকলেও ‘বনলতা সেন ‘ সম্পূর্ণভাবে কবির গভীর ভাবনা থেকে উঠে আসা নিজস্ব ভঙ্গিতে লেখা একটি অনন্যসাধারণ কবিতা যার সাথে জড়িয়ে আছে কবির গভীর জীবনবোধ ও নিজের জীবনের না পাওয়ার বেদনা অন্ধকাররূপে বিস্তৃত হয়েছে পুরো কবিতায়।

কবিতার তিনটি স্তবকের প্রতিটির শেষে যে বনলতা সেনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তিনি আসলে কে? ভিন্চির মোনালিসা কিংবা শেক্সপিয়ারের ডার্কলেডী নিয়ে পাঠকদের মধ্যে যে ধোঁয়াশা ও কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে ঠিক একইভাবে বনলতা সেন বাঙালি পাঠকদের মনে কুহক তৈরি করে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। জীবনানন্দের কঠোর সমালোচক সজনীকান্ত দাস এ নিয়ে বলেছেন, “ এই প্রতিভাবান কবিদের আর একটি কৌশল কবিতা লিখিতে লিখিতে অকস্মাৎ অকারণ একজন ভদ্রমহিলার নাম করিয়া আমাদিগকে উৎসুক আর উৎসাহিত করিয়া তোলা। “ কোন কোন সমালোচক বলেছেন, “পৌষের চন্দ্রালোকিত মধ্যরাত্রির মতো তাঁর কাব্য কুহেলি কুহকে আচ্ছন্ন। “ ক্লিন্টন বি. সিলি তাঁর অ্যা পোয়েট এপার্ট গ্রন্থে বলেছেন, “ সেন বলতে বৈদ্য গোত্র বোঝায় যা জীবনানন্দেরও গোত্র। অন্য বাংলা নামের মতো বনলতারও রয়েছে একটি আক্ষরিক অর্থ। নামটির অর্থ বনের লতা, যা রূপসী বাংলার নৈসর্গিক পরিবেশের প্রতি জীবনানন্দের প্রবণতার কারণে তাঁকে প্রলুব্ধ করতে পারে। “ তবে অশোক মিত্র বলে বলেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। তিনি কবি জীবনানন্দ দাশকে বনলতা সেন কে এটি জিজ্ঞেস করেছিলেন। উত্তরে কবি বলেছিলেন যে ১৯৩২ সালের আশেপাশে আনন্দবাজার পত্রিকা বনলতা সেন নামের এক বন্দিনী জেলে আছে এরকম একটি খবর ছাপিয়েছিল, সেখান থেকে তিনি এই নামটি তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছেন।
কবিতাটি কবির মৃত্যুর পর তাঁর আট নম্বর খাতার ২৪ তম পৃষ্ঠায় পাওয়া যায় (কবি খাতাগুলোকে ১,২,৩- এভাবে নম্বর দিয়ে রাখতেন)। কোলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে এই পান্ডুলিপিটি সংরক্ষিত আছে। ড. ভুমেন্দ গুহ গবেষণা করে জানিয়েছেন যে, কবির মৃত্যুর পর তাঁর ট্রাঙ্কে পাওয়া লিটারেরি নোটস-এ ইংরেজি অক্ষর ওয়াই (Y) হিসেবে উল্লিখিত মেয়েটিই যে কবির কাঙ্খিত নারী সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। বাস্তবে তার নাম শোভনা, যে কবির এক কাকার মেয়ে। ১৯৩০ সালে লাবণ্য দাশকে বিয়ে করার আগেই যুবক জীবনানন্দের ছিল এর প্রতি গভীর অনুরাগ। সে অনুরাগের কারণে হয়তো বা কবি বনলতা সেন এর নামের আড়ালে তাঁর প্রেমিকার অসাধারণ সৌন্দর্য কাব্যিক ভাষায় বর্ণনা করেছেন, তার কাছে দুদন্ড শান্তির প্রত্যাশী ছিলেন, সাময়িক নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যও ছুটে গেছেন তার কাছে। আর গভীর আবেগপ্রসূত এই সৃষ্টি বাংলা কাব্যজগতে অমরত্ব লাভ করেছে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে।
‘বনলতা সেন ‘ কবিতাটি বাংলা আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত হয়ে কল্লোলযুগের যে পাঁচজন কবি আধুনিক কবিতার সন্ধানে নিবেদিত ছিলেন তাঁদেরকে সঠিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করছে এই কবিতাটি। এই কবিতায় নেই কোন বিদ্রোহ, নেই দম্ভ কিংবা নিজের অনন্যতা প্রকাশ করার কোন প্রচেষ্টা। রোমান্টিককতার আবরণে অত্যন্ত নিবিড় বুনোটের মাধ্যমে কবি সভ্যতার পথে মানুষের পরিভ্রমণ ও গন্তব্যের কথা মনোরম শব্দবিন্যাসে তিনটি স্তবকের আঠারোটি লাইনে হৃদয়স্পর্শী ধ্বনিতে বর্ণনা করেছেন। অন্যভাবে বলা যায় যে, কোন এক বিভ্রান্ত পথিক ইতিহাসের পথে হেঁটে হেঁটে অন্ধকারাচ্ছন্ন বিভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থানে পৌঁছে গেছে কিন্তু তার রয়েছে মানসিক শান্তির আকুতি যার জন্য সে ঘোর অন্ধকারে খুঁজে পাওয়া প্রেমিকার কাছে ক্ষণিকের জন্য হলেও ছুটে যায়। অনেকে মনে করেন, বনলতা সেন কবিতাটি কখনও কখনও কবি জীবনানন্দকে ছাড়িয়ে অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে যায় যার স্পর্শে পাঠক-হৃদয় হয় উদ্বেলিত, আবেগাক্রান্ত ও পূর্ণ।

ক্লান্তপথিক আমাদের কবি হাজার বছর ধরে পরিভ্রমণ করে চলেছেন এই পৃথিবীর পথ ধরেই। তিনি কাল্পনিক সিংহল সমুদ্র ও মালয় সাগরকে তাঁর চলাচলের স্থান হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিক চরিত্র বিম্বিসার ও অশোক এর অন্ধকারাচ্ছন্ন ধূসর জগতে এবং অন্ধকার বিদর্ভ নগরে তাঁর যাতায়ত ছিল। জীবনের টানাপোড়েনে অবসন্ন পথিক দুদন্ড শান্তি পেয়েছেন নাটোরের বনলতা সেনের কাছে। তার চুল বিদিশা নগরীর রহস্যময় অন্ধকারের মতো, তার মুখশ্রী শ্রাবস্তীর কালজয়ী শিল্প-উপাদান হিসেবে চিহ্নিত।

সমুদ্রের দিকভ্রান্ত নাবিক দারুচিনি দ্বীপে যে সবুজের সন্ধান পেয়ে থাকে তেমনি কবি খুঁজে পেয়েছেন ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন’ বলা মিষ্টিভাষী বনলতা সেনকে যার রয়েছে পাখির নীড়ের মতো চোখ। দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা নামলে চিল তার ডানার রৌদ্রৈর গন্ধ মুছে ফেলে, পাখি ও নদীর তখন ঘরে ফেরার তাড়া শুরু হয়, সেরকম কবিও জানেন তাঁকে তাঁর নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছুতে হবে, কিন্তু তার আগে আরেকবার তিনি অন্ধকারে বনলতা সেনের মুখোমুখি বসতে চান।
আমরা পুরো কবিতা বিশ্লেষন করে এই ধারণায় নিশ্চিতভাবে উপনীত হতে পারি যে, এই বনলতা সেন কবির প্রেমিকা ছাড়া আর কেউ নয় যাকে তিনি নিবিড়ভাবে কাছে পেতে চেয়েছেন কিন্তু সামাজিক বাধার কারণে সেটা আর হয়ে উঠেনি। অনেক সমালোচক বনলতা সেনকে একজন বারবণিতা হিসেবে আর নাটোর সেসময় বারবণিতাদের বিচরণক্খেত্র বলে উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র ও তাঁর দিনলিপি থেকে জানা যায় যে কবি বারবণিতাদের কাছে যেতেন নাটোরে নয় দিল্লীতে। তাই বিভিন্ন সমালোচক দুয়ে দুয়ে চার মেলানোর মত করে তাঁদের বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সত্য হলো এই যে, যুবক কবির প্রেমিকা শোভনা কবির সমস্ত জীবন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। গভীর প্রেমের সম্পর্ককে তিনি সারাজীবন নিজের মধ্যে লালন করেছেন, প্রকাশ করেছেন তাঁর কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাসে। দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী লাবণ্য দাশের সাথে ভীষণ অসুখী ছিলেন তিনি আর ছিলেন প্রচন্ড অর্থকষ্টে। এই কালজয়ী কবিতার প্রকাশকালে তিনি সিটি কলেজের সহকারী প্রভাষকের চাকরি হারান। সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন বাস্তবের কষাঘাতে পিষ্ট একজন নিভৃতচারী অসুখী মানুষ। কিন্তু কাঙ্খিত প্রেমিকা শোভনার কথা ভাবনায় এলে তাঁর জীবনের সব অন্ধকার মুছে যেতো, কল্পনায় শোভনার চোখে খুঁজে পেতেন নিশ্চিত, নিরাপদ আশ্রয়। যদিও শোভনার সাথে দেখা হবার বা পরবর্তীতে সম্পর্ক চালিয়ে যাবার কোন ঘটনার কথা গবেষণায় উঠে আসেনি তাই আমরা ধরে নিতে পারি যে কল্পনাপ্রবণ বিষাদগ্রস্ত কবি বনলতা সেনের মধ্যে আঁকতে চেয়েছেন তাঁর প্রেমাস্পদের ছবি। তাই তো বনলতা সেন প্রেমের প্রতীক, শান্তির প্রতীক, নিরাপদ আশ্রয়ের প্রতীক – যার খোঁজে কবি তাঁর জীবনের প্রগাঢ় অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়গুলো পার করেছেন। বনলতা সেনের সঠিক পরিচয় নিয়ে পাঠকের মনে নানা বিভ্রান্তির সৃষ্টির প্রচুর অবকাশ থাকা সত্ত্বেও এই কবিতাটি একটি প্রেমের কবিতার অনন্যসাধারণ নিদর্শন হিসেবে বাংলা কাব্যজগতে জায়গা করে নিয়েছে। ক্লান্ত শ্রান্ত কবি অন্ধকারে এক নারীর মুখোমুখি বসে যে আবহ সৃষ্টি করেছেন তা পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রাখে। তাই তো লেখক শাহাদুজ্জামান তাঁর ‘একজন কমলালেবু ‘গ্রন্থে বলেছেন,” বনলতা জীবনানন্দের চেয়েও জনপ্রিয়। জীবনানন্দের নামের চেয়ে লোকে বেশি জানে বনলতা সেনের নাম। বনলতা সেন হয়ে উঠেছে রীতিমতো জনসংস্কৃতির অংশ। হাজির হয়েছে বাংলা গানে, চলচ্চিত্রে, নাটকে।