বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। চারিদিকে সাজ সাজ রব। বাঙালি মুজিববর্ষ পালন করতে প্রস্তুত। জন্মশতবর্ষের আগে বাংলাদেশের বুকে জাতির জনকের এভাবে গৌরব জনকভাবে ফিরে আসা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এই ধ্রুব সত্য যে, বীরের রক্ত কখনো বৃথা যায় না। জন্মশতবর্ষ ঘিরে এত আয়োজন দেখে আমার কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। বলাবাহুল্য কথাগুলো অবশ্যই নতুন প্রজন্মের জন্য।
আমাদের প্রজন্মের শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল মুজিববিহীন বাংলায়। আবার শিক্ষাজীবন শেষও করেছিলাম আওয়ামীলীগ ক্ষমতার বাইরে থাকা অবস্থায়। আওয়ামীলীগ যে একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল ওইসময়কালটাই ছিল আমাদের শিক্ষাজীবনের পরিধি।এ কথাটা বলার কারণ আমরা কখনো পাঠ্যবইয়ের সিলেবাসে শেখ মুজিবকে পাইনি। অথচ কী গভীরভাবে বঙ্গবন্ধু আমাদের হৃদয়ে প্রোথিত। মাঝে মাঝে আমার ভাবনায় আসে বঙ্গবন্ধু নামটি যখন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ,বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙানো যখন বাংলাদেশে গুরুতর অপরাধ তখন কীভাবে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর সব ইতিহাস জেনে গিয়েছিলাম! কীভাবে আমরা জেনেছিলাম বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ সমার্থক দুটো শব্দ।আসলে বঙ্গবন্ধুর দীক্ষাটা আমরা পেয়ে গিয়েছিলাম পরিবার থেকে। বঙ্গবন্ধু এমনই এক বীজমন্ত্র যে ধারণ করতে পারে,তার আর অন্য কোনো মন্ত্রের দরকার হয় না।
আমরা যারা মুজিবকে ভালোবাসতাম, ঘরের মধ্যে পরম মমতায় শেখ মুজিবের ছবি টাঙিয়ে রাখতাম তারা সবাই যে আওয়ামীলীগ করতাম,তা কিন্তু নয়। হয়তো আমাদের অনেকের পরিবারই রাজনৈতিক সংশ্রব থেকে দূরে ছিল,কিন্তু পরিবার থেকে এ শিক্ষা আমরা পেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ।বঙ্গবন্ধু না থাকলে এ দেশটি কখনো স্বাধীন হতো না।তবে এ সত্যটা প্রকাশ্যে বলার মতো মানুষের বড্ড আকাল ছিল।বরং শেখ মুজিবকে চৌদ্দ গুষ্ঠি ধরে গালিগালাজ করার মানুষে চারপাশ তখন সয়লাব ছিল। অনেকেই তখন বিশ্বাস করতেন আওয়ামীলীগ আর কোনোদিনই ক্ষমতায় আসতে পারবে না। তাই মুজিবপ্রেমী হয়ে রাষ্ট্রের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি সহজেই কেউ নিতে চাইতেন না।
তবুও কেউ কেউ থেমে থাকেনি।সামরিক বাহিনীর খড়গহস্তে রাজনীতিবিদরা যখন কোণঠাসা তখন বঙ্গবন্ধুকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দিতে এগিয়ে এসেছিল সাংস্কৃতিক কর্মীরা।কবিতায়, ছড়ায়, শিল্পীর পোস্টারে, দেওয়াল লিখনের স্লোগানে স্লোগানে বঙ্গবন্ধুকে তখন ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিলো দেশের আনাচে-কানাচে, অলিতে-গলিতে,পাড়ায়-পাড়ায়।
১৯৮৯ সালে যখন চট্টগ্রামে প্রথম বিজয়মেলা অনুষ্ঠিত হয় এবং স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধারা যখন প্রকাশ্যে লাখো জনতার সামনে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরে জয় বাংলা, জয়,বঙ্গবন্ধু শ্লোগান তোলেন তখন চারপাশ প্রকম্পিত করে জনতার একই শ্লোগান আজও কানে বাজে।চট্টগ্রাম এর বিজয়মেলা তৎকালীন তারুন্যকে মু্ক্তিযু্দ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর সঠিক ইতিহাস জানাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। যা পরবর্তীতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আজও মনে পড়ে সেসময় রাজাকার বিরোধী বিভিন্ন পোস্টার,মুখোশ এবং আবৃত্তির ক্যাসেট বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।এরই রেশ ধরে জনরোষের কারণে গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৯০ এর ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন ঘটে।
পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসবে মনে করে নিশ্চিত থাকলেও সমস্ত হিসাব নিকাশকে পাল্টে দিয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। তখনো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেকের মনে দ্বিধা ছিল।স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে চলতো অহেতুক মতবিরোধ। অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার পরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে। আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে সারাদেশে বাজতে থাকে ৭ই মার্চের ভাষণ। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এবং রেডিওতে প্রচারিত হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের নানা ডকুমেন্টারি। যেসব সত্য এতদিন অমীমাংসিত ছিল,সেসব সত্য এবার প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে মীমাংসিত হতে থাকে। এসময় সত্যিকারভাবেই অনেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আকৃষ্ট হয়।
তবে এ অবস্থা বেশিদিন চলতে পারে না।আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার দুই/তিন বছর পর থেকেই শুরু হয় সরকার বিরোধী আন্দোলন। এক পর্যায়ে আওয়ামীলীগের শাসনকাল শেষ হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। তবে বিএনপিও নির্বিঘ্নে তার শাসনকাল পার করতে পারে না।তীব্র সরকারবিরোধী আন্দেলনের মধ্যে শাসনকালের মেয়াদ শেষ করে একতরফা নির্বাচন দিয়ে বিএনপি বেকায়দায় পড়ে। সামরিকবাহিনীর হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা চলে যায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে।
এরপর দুই বছরের অনেক প্লাস মাইনার নাটকের পর অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে আওয়ামীলীগ নির্বাচনের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে ২০০৮ সালে। এরপর আরও দুটি নির্বাচন সম্পন্ন করে এখনো আওয়ামীলীগ ক্ষমতায়।টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকাতে দেশে মুজিবপ্রেমীর সংখ্যা বেড়েছে। যে বঙ্গবন্ধুর লাশ ৩২ নম্বরের সিঁড়ি থেকে সরাবার জন্য লোক পাওয়া যায়নি, সে বঙ্গবন্ধুর জন্য এখন যে পরিমান লোক অশ্রু বিসর্জন করে তা জমিয়ে রাখতে পারলে আরেকটি বঙ্গোপসাগর হয়ে যেতো। তবে তাদের মধ্যে কজন বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে কিংবা মস্তিষ্কে ধারণ করে তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
চারপাশে বক্তৃতায় এখন শোনা যায় মুজিববন্দনা। ব্যাপারটা তো খুবই ভালো হওয়ার কথা।যে দেশে একদিন শেখ মুজিবের নাম প্রকাশ্যে উচ্চারণ নিষিদ্ধ ছিল,যে দেশে একদিন শেখ মুজিবের ছবি রাখা অপরাধ বিবেচিত হতো সেদেশে আজ চারদিকে শেখ মুজিবের জয়জয়কার তো গৌরবেরই কথা। কিন্তু যখন দেখি তথাকথিত মুজিবপ্রেমীরা শেখ মুজিব সম্পর্কে কোনো তথ্যই সঠিকভাবে জানে না,এমনকি তাঁর বাবা মায়ের নাম, তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে পর্যন্ত তাদের ন্যূনতম ধারণা নেই, তখন ভয় হয় তারা শেখ মুজিবের আদর্শ সম্পর্কে জানে তো? তারা জানে তো শেখ মুজিব কেন পাকিস্তানি আদর্শকে কবর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন? স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় চারনীতি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা আছে কি?
বলতে খারাপ লাগে তারপরও বলতে হয়,বঙ্গবন্ধুকে আজকাল কেমন যেন বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করা হয়।কয়েকদিন আগে এফবিতে দেখলাম বঙ্গবন্ধুর মুখোশ বানিয়ে জনৈক মন্ত্রীকে একটি বালিকা বিদ্যালয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে।ছবিটা যখন এফবিতে ভাইরাল হলো তখন খুব খারাপ লেগেছে।কারণ বঙ্গবন্ধুর মুখোশধারীরা সবাই ছিল হিজাবপরিহিতা। অদ্ভুত এক দৃশ্য! দলে দলে মাথায় ঘোমটা দেয়া শেখ মুজিব দাঁড়িয়ে আছেন মন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে,যা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু লেগেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে এরকম হাস্যকর দৃশ্যের উদ্রেককারীদের নিয়েই আমাদের শংকা জাগে।
আমাদের মনে রাখতে হবে শেখ মুজিবুর রহমান নিছক কোনো ব্যক্তির নাম নয়। এ নামটি একটি আদর্শের প্রতীক। তাঁকে ভালোবাসতে গেলে, তাঁর আদর্শ অন্তরে ধারন করতে গেলে আওয়ামীলীগ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তিনি আপামর বাঙালির নেতা। বাঙালিমাত্রই তাঁকে শ্রদ্ধা করতে হবে। কারণ তিনি এ ভাষাভিত্তিক জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রটির জন্ম দিয়েছিলেন।
এ বাংলা অনেক নেতার জন্ম দিয়েছে।এখানে আছে নূরলদীন, তিতুমীর, সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, সুভাষবসু, সোহরাওয়ার্দি, শেরে বাংলার বীরত্বগাথা। আছে ঈসা খান, প্রতাপাদিত্যের হার না মানা কাহিনি। তাঁরা সবাই লড়েছেন বাংলার জন্য,বাংলাকে বহির্শত্রুর কবল থেকে মুক্ত রাখার জন্য।কিন্তু তাঁরা কেউ বাংলাকে সার্বভৌমত্ব দিয়ে যেতে পারেননি।একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানই পেরেছিলেন বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বানিয়ে যেতে। তিনিই দিয়েছিলেন আমাদেরকে একটি মানচিত্র, একটি জাতীয় পতাকা ও একটি জাতীয় সঙ্গীত।
তাই সুবিধাদি পাওয়ার লোভে নয়, অন্তরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করেই আমাদের মুজিবপ্রেমী হতে হবে।তাঁর জীবনী পড়ে,তাঁর সম্পর্কিত নানা বই পড়ে তাঁকে জানতে হবে। তাঁর জীবনাচার, তাঁর চিন্তাধারা, তাঁর আদর্শকে অন্তর থেকে গ্রহণ করতে পারলে তবেই আমাদের মুখে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান যথার্থতা পাবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ-চট্টগ্রাম