শ্রমজীবী মানুষের অধিকার রক্ষায় পালিত হয় মহান মে দিবস। এই মে দিবসের আগে অনেকের অজানা ছিল শ্রমিকেরা কীভাবে নিষ্পেষিত হতো মালিকের দ্বারা। শ্রমিকেরা রক্ত দিয়েই নিজেদের অধিকার আদায় করে নিয়েছিল। সারা বিশ্বব্যাপী শ্রমিকের এ আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ মহান মে দিবস আন্তর্জাতিকভাবে পৃথিবীর দেশে দেশে পালিত হয়। মে দিবসের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সেটা হচ্ছে ক্ষোভ থেকে বঞ্চনাএবং বঞ্চনার ফলশ্রুতিতে বিরোধেরই জন্ম হয়। ১৮৮৬ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে জীবন উৎসর্গ করে প্রমাণ করেছিলেন যে দাবি আদায়ের জন্য একটি সম্মিলিত ঐক্যের প্রয়োজন হয় সময়ের প্রয়োজনে। সারা পৃথিবীতে উৎপাদনশীলতায় দুটি পক্ষ একটি হচ্ছে মালিক পক্ষ অপরটি শ্রমিকপক্ষ। এ দুটো পক্ষের মনস্তাত্ত্বিক শীতলযুদ্ধ চিরকালের। শ্রমিকদের এত আত্মত্যাগের পরও দেশে দেশে শ্রমিক-মালিক পক্ষের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব বা বিরোধ নিয়ে নানা শিরোনাম আমাদের চোখ পড়ে। এখানে স্বাভাবিক যে নিয়মের কথা আমরা বলি তা হলো, শ্রমিকেরা নিজেদের দায়িত্ব যথাযথ দায়িত্ব পালন করবে এবং তেমনি মালিক পক্ষের দায়িত্ব হচ্ছে শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেয়া। এছাড়া শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি ও অধিকারের প্রতিও নজর রাখা মালিকের কর্তব্য। শ্রমিক নিয়োগের আগে মালিক পক্ষকে অবশ্যই শ্রমিকের কার্যকাল সময় ও মজুরি নির্ধারণ করে দেয়া দরকার। শ্রমিকের কাজ শেষ হওয়ার পর তার ঘাম শুকানোর আগেই পারিশ্রমিক দিয়ে দেওয়া মালিকের কর্তব্য। শ্রমিক ও মালিকের পারস্পরিক সুসম্পর্কের কারণেই উৎপাদনে গতিশীলতা আসে। এ সম্পর্কের ব্যতিক্রম মানে শিল্পে দ্বন্দ্ব বা অসন্তোষ। শ্রমিক-মালিক দ্বন্দ্ব কাজে বিঘœ ঘটায়; আর এ পরিবেশ শ্রমিককে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে। শ্রমিক-মালিকের মাঝে পারস্পরিক সুসম্পর্ক সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করে বিশৃঙ্খলামুক্ত ও শান্তিময় এক অনাবিল পরিবেশ। মে দিবসের এ শিক্ষা শুধু শ্রমিক-মালিক পক্ষকেই নিয়েই আলোচনার বিষয় হিসাবে না দেখে সমাজের বিদ্যমান নানা পক্ষের নানা অসহিষ্ণু পরিবেশের দিকে তাকালে অনেক সমস্যার সহজ সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়। পারষ্পরিক দ্বন্দ্ব বা অবিশ্বাস সবসময়ই নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। সমাজে উচ্চবিত্ত বা প্রভাবশালীরা অনেক সময় নিচের দিকের মানুষগুলোকে অনেক কিছুই জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়। দেখা যায় এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে নিজেকে ক্ষমতাধর বা প্রভাবশালী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবার প্রয়াস থাকে। সেখানে হয়তো অনেকেই যে কোনো কারণেই হোক অধীনস্থরা হয়তো সামনে কিছু বলেন না, কিন্তু সেখানে কাজের কোনো আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকে না। তার সুদূরপ্রসারী ফল খারাপই হয়। সমাজ অনেক পক্ষকেই নিয়েই আমাদের কাজ করতে হয় বা চলতে হয়। শ্রমিক-মালিকের ইতিবাচক সম্পর্ককে আমরা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের আলোকেও ব্যাখা করতে পারি। ভালো ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক জ্ঞানের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে। এখানে মে দিবসের যে ঘটনা প্রবাহ ছিল তা হলো শ্রমিকদের প্রতি মালিকের ক্রমাগত শোষণ। সেই শোষণ চলেছে যুগের পর যুগ। সে ক্ষোভই একদিন দাবানলে পরিণত হয়েছে, যার পরিণতি সংঘাত এবং মৃত্যু। সেটি একটি এখন ইতিহাস এবং সে ইতিহাস আমাদের জন্য পরম শিক্ষা। এখানে খেয়াল করলে দেখা যায় শ্রমিক ও মালিক পক্ষের মধ্যে অহিষ্ণুতার যে প্রকাশ তার চিত্র সমাজে নানা পক্ষের মধ্যেও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। সমাজে ছাত্র-শিক্ষক যেমন একটি দুটো পক্ষ তেমনি শিক্ষকসহ নানা পেশাজীবী শ্রেণিরও নানা পক্ষ আছে। যাদের মাধ্যমেই প্রত্যেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে নিজেদের কার্য সম্পাদন করেন। এ পক্ষগুলোর মধ্যেও ইতিবাচক সম্পর্ক ভালো একটা শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবেশসহ প্রত্যেক পেশাজীবীর জন্য ভালো একটি কাজের পরিবেশ তৈরি করতে পারে। সেখানে যদি শুধু কর্তৃত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি হয় তাহলে সেখানে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি হতে পারে না। বেশি কর্তৃত্বের সর্ম্পক দূরত্ব সৃষ্টি করে আর দূরত্ব কখনো ভালো ফল বয়ে আনে না। এই বেশি কর্তৃত্বের সর্ম্পকই শ্রমিক-মালিকদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছিল। সন্দেহ অবিশ্বাস বৈরি পরিবেশের জন্ম দেয়। শ্রমিক যদি মনে করে মালিক তাকে ঠকাচ্ছে, আর মালিক যদি মনে করে শ্রমিকরা ফাঁকিবাজ, তাদের কাজ থেকে জোর করে কাজ আদায় করতে হবে, তাহলে সেখানেই জন্ম নেবে শিল্পবিরোধের। এই বিশ্লেষণটা মে দিবসের হলেও আমরা ছাত্র-শিক্ষক, শিক্ষক-মন্ত্রণালয় বা বিভিন্ন পেশাজীবী এবং তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, এমনকি একটি পরিবারের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যেও তার উদাহরণের রেশ টানতে পারি। সুতরাং মে দিবস শুধু একটি দিন নয় এর পিছনের ইতিহাসের নিগুঢ় সত্যের ইতিহাসকে আমরা যদি ধারণ এবং লালন করতে পারি তাহলে অসহিষ্ণুতার অনেক পরিবেশকেও শীতল করতে পারি। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা বিভিন্ন পক্ষের পারষ্পরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্কেরই ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। আমরা ছোটবেলা থেকেই জেনে আসছি মানুষ একাকী বসবাস করতে পারে না এবং সেটাই সত্য। পারষ্পরিক সম্পর্কের যে টানাপোড়েন সেটা শুধু শ্রমিক মালিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সেটা সমাজে বসবাসকারী উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিভিন্ন শ্রেণির পদপদবীর মানুষের মধ্যেও বিদ্যমান। মে দিবসের যে রক্তক্ষয়ী আত্মত্যাগ তা ছিলো এক ধরনের শিল্পবিরোধের সর্বশেষ চিত্র। সে ঘটনা বিশ্বে বিবেকবান মানুষের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলো যে, বঞ্চনা, শোষণ ও নিপীড়ন যখন সহ্যের সীমা অতিক্রম করে তখনই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সহনশীল ও পারষ্পরিক বোঝাপড়ার বিকল্প নেই। সমাজে বসবাসকারী উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিভিন্ন শ্রেণির পদপদবীর মানুষের মধ্যেও পেশাগত বিভিন্ন বিষয়ে এক ধরনের স্নায়ু লড়াই বা বিরোধ থাকতেই পারে। তা উপলব্ধি করার দায়িত্ব কিন্তু সবসময় উপরের মহলের ওপরই বর্তায়। কারণ তারা নানা দিক দিয়েই প্রভাবশালী। তারা যদি এটা বুঝতে অক্ষম হন সেখানেই ঘটে বিপত্তি। একটি সহনশীল পরিবেশ সৃষ্টিই যে কোনো জায়গায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। মে দিবসের যে নিগুঢ় তাৎপর্য তাহলো উৎপাদনশীলতা ও প্রবৃদ্ধি অর্জনে শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্কের যেমন বিকল্প নেই তেমনি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের জন্য উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিভিন্ন শ্রেণির পদ-পদবীর মানুষের মধ্যেও একটি ইতিবাচক সম্পর্কের কোনো বিকল্প নেই। আইনে শ্রমিককে আলাদাভাবে সজ্ঞায়িত করা হলেও আমরা সকলেই নানামুখী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শ্রমই দিয়ে থাকি। সুতরাং আমাদের সাথে সহযোগী নানা ধরনের মানুষদের প্রতিও আমাদের সহানুভূতিশীল থাকা দরকার। বিরোধ শুধু শিল্প কলকারখানাতে নয়, যে কোনো জায়গায় হতে পারে। মে দিবসের শিক্ষাকে নিজেদের মধ্যে ধারন করতে পারলে অনেক কিছুই অর্জন করা সম্ভব।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি কলেজ; প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক।