বঙ্গবন্ধু মানেই একটি দেশ। বঙ্গবন্ধু মানে একটি পতাকা। মহান এই নেতাকে নিয়ে লিখেছেন অনেকেই। আমরা জানি, একটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। যাঁর ডাকে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে এদেশের মানুষ নয় মাস যুদ্ধ করে এনেছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ভাষার জন্যে, স্বাধীন একটি ভূখণ্ডের জন্যে এতো রক্ত পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো দেশের নেই। কিন্তু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু কেমন ছিলেন? তাঁর মনে দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা, তাঁর মানবিকতা, অর্থনীতি ভাবনা, মানব সত্তার চূড়ান্ত বিকাশ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাহিত্য ভাবনা, সংস্কৃতি ভাবনা, শিশুপ্রেম- শিশু সংগঠন পৃষ্ঠপোষকতায় অবদান, নারী উন্নয়ন, স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, ভাষা আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দি, প্রকৃতি প্রেম, প্রতিরক্ষা চিন্তা, পুলিশের প্রতি ভালোবাসা’র কথাগুলো আমরা জানতে পারি খ্যাতিমান কবি সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক রাশেদ রউফের ‘দশ দিগন্তের বঙ্গবন্ধু’ বইটিতে। বইটির শেষ অধ্যায় রচিত হয়েছে ‘বাঙালির শোকের দিন’ নামক ইতিহাসের সেই কালো কুখ্যাত রাত ১৫ আগস্টের শোকাবহ আবেগ নিয়ে। এই বইটিতে আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি পাই, একজন সাধারণ মানুষকে। যাঁর উদারতা, বাগ্মীতা, দূরদর্শিতা, দেশপ্রেম, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতাসহ নানা গুনে গুণান্বিত ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে। প্রতিটি মানুষের জীবনে একটি নিজস্ব জগত থাকে। নিজের একটি আলাদা জগত । গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে আমরা পাই মানুষের প্রতি তার মানুষের প্রতি তাঁর দুর্দমনীয় ভালবাসা। তাঁর জীবন দর্শন ছিল এদেশের গণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। তাদের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। তার একটি অসাধারণ উক্তি,’৭ কোটি বাঙ্গালীর ভালোবাসার কাঙ্গাল আমি। সব হারাতে পারি কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না। একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়ে আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙ্গালীদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা। যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ যিনি এমন উদারচিত্তে বাংলার মানুষকে ভালোবেসেছেন, তিনি তো বাঙালির প্রাণের নেতা হবেনই। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে প্রথমে বঙ্গবন্ধুর জনগণের মুখোমুখি। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে তিনি নিজের বাড়িতে না গিয়ে সরাসরি উদ্যানে চলে আসেন। এখানেই তার ভালোবাসার প্রকাশ পায় আরো নিবিড় ভাবে। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে ৭৩ জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বলেন, ‘পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত। একটি শোষকের বিশ্ব আরেকটি শোষিতের। আমি শোষিতের পক্ষে।’ তাঁর এই উক্তির মাধ্যমে বোঝা যায় তিনি শুধু বাঙালি নন, বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ছোটো ছোটো কথার ব্যাপকতা ছিলো অনেকবেশি। তাই বিশ্বের কাছে নন্দিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে তাঁর সময় লাগেনি। বঙ্গবন্ধুর কৃষি ভাবনায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের কৃষক সমাজ। গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অপরিসীম। তৃতীয় অধ্যায় ‘বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি :মানবিক ও সুদূরপ্রসারী’। এই অধ্যায়ে আমরা পাই, তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পররাষ্ট্রনীতি। যা বহির্বিশ্বে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তৈরিতে অতুলনীয় ভূমিকা রেখেছিলো। ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারো প্রতি বৈরিতা নয়’ এই নীতিতে বঙ্গবন্ধুরের নীতি তাঁর জাদুকরী ক্ষমতা এবং ব্যক্তিত্বের কারণে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের ১৩৬ টি দেশের মধ্যে ১২৬টি দেশই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক কথা বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান। দেশকে শক্ত করে দাঁড় করানো ছিল বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মূল আদর্শ ও লক্ষ্য। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশকে কিভাবে আবার নতুন করে দাঁড় করানো যায়, সেই চিন্তা চেতনা নিয়ে রচিত হয়েছে চতুর্থ অধ্যায়। এর পরের অধ্যায়ে শিক্ষকদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধার প্রকাশ দেখতে পাই। শিক্ষকদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিলো অপরিসীম। গোপালগঞ্জ খ্রিস্টান মিশনারি হাই স্কুলের শিক্ষক গিরিশ বাবু তাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। সে কথা তিনি কখনোই ভোলেননি। শিক্ষকদের সিদ্ধান্ত বা আদেশকে গ্রহণ করতেন শ্রদ্ধার সঙ্গে। ছাত্র জীবনে তাঁর অন্যতম আদর্শ শিক্ষক কাজী আব্দুল হামিদের প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সেবা সমিতির জন্য কাজ এবং পরবর্তী সময়ের দায়িত্ব নেওয়ার মাধ্যমে আমরা বঙ্গবন্ধুর ছাত্র জীবনের আদর্শকে খুঁজে পাই। গ্রন্থের লেখক এখানে বঙ্গবন্ধুর মানব সত্তার দিকটি উন্মোচন করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। তাঁর চরিত্রে কখনো ধর্মীয় বৈষম্য ছিলো না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন আজন্ম অসাম্প্রদায়িক। তাঁর কৈশোর সম্পর্কে যখন আমরা এই গ্রন্থে পড়ি তখন দেখি, তিনি কখনোই হিন্দু মুসলমান ভাগ করেন নি। হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে তাঁর ছিলো বন্ধুত্ব। তিনি ‘বাঙালি’ শব্দের মধ্যে বাংলার সব ধর্মের মানুষকে এককাতারে রাখতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজ উইক পত্রিকা ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলো। অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন বইগুলোতে একজন লেখক হিসেবেও আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন ‘দশ দিগন্তে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থের লেখক রাশেদ রউফ। সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি বঙ্গবন্ধুর সংস্কৃতি ভাবনাও তুলে ধরেছেন পাঠকের কাছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে বঙ্গবন্ধু ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ রবীন্দ্রনাথের লেখা এই গান নির্বাচন করেছিলেন। রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত ছাড়াও আব্বাসউদ্দীনের ভাটিয়ালি গান বঙ্গবন্ধুর ছিলো পছন্দের। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই বাংলাদেশ টেলিভিশন রামপুরায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসহ তাদের কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি। এই তথ্যগুলোও আমরা উল্লিখিত গ্রন্থে পাই। ১৯৬৩ সালে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে কচিকাঁচার মেলার উদ্যোগে আয়োজন হয় দশ দিনব্যাপী শিশু আনন্দমেলা। যার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক সংগঠক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই। শিশু-কিশোরদের কাছে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ‘মুজিব ভাই’। তিনি শিশুদের উৎসাহ দিতেন মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকার জন্য। এই অধ্যায়টি পড়তে পড়তে মনে হয় বঙ্গবন্ধু আমাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন শিশুর মত সহজ সাবলীল সারল্য নিয়ে। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা পাই, নারীর ক্ষমতায়ন। যেখানে তিনি নারীর সামাজিক সম্মান ও মর্যাদা উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তার পরবর্তী অধ্যায় ওই মহামানব আসে। এই অধ্যায়ে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার দিনটির কথা লেখা হয়েছে। যে প্রত্যাবর্তনকে বঙ্গবন্ধু আখ্যায়িত করেছিলেন, ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা’। এই দিনটি বাঙালির জন্য পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের দিন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর আবেগাপ্লুত ভাষণের কথা লেখা আছে এই অধ্যায়ে। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। কিন্তু অনেকেই জানিনা প্রথম কারাবন্দী কে ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সংগ্রামী বঙ্গবন্ধু অধ্যায়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বঙ্গবন্ধুর ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার কথা আমরা জানতে পারি এই অধ্যায় পড়ে। বাংলাদেশ প্রকৃতির নিটোল নিসর্গ সৌন্দর্যে গড়া একটি দেশ । নদী, পাহাড়, সাগর, সবুজে মিলেমিশে একাকার এই দেশ। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রকৃতির এক অকৃত্রিম সন্তান। কারাগরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিল বই আর প্রকৃতি। জেলখানায় তিনি সবজি আর ফুলের বাগান করেছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আমরা সেই বাগান এর বর্ণনা পাই। বঙ্গবন্ধুর প্রকৃতি প্রেম অধ্যায়ের আমরা এমন একজন নেতাকে পাই যিনি দুটি হলদে পাখিকে খুঁজতেন। দাঁড় কাক আর ছোটো কাকের ঝগড়া দেখতেন। আবার তাদের ভালোবেসে গাছ ছেড়ে দিতেন বাসা করার জন্য। জেলখানার ভেতরে ছোট ছোট মাঠগুলোকে দূর্বা লাগিয়ে সবুজ করে তুলেছিলেন। বাংলাদেশের পতাকার মতো। একজন সত্যিকারের প্রকৃতিপ্রেমিক ছাড়া মাটির জন্য এই মায়া অন্য কারো থাকার কথা নয়। জীবনানন্দের ভাষায় বলতে গেলে, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’
কথাটি যেন বঙ্গবন্ধুর বেলা এসে আরও বেশি মিলে যায়। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মতো পুলিশ বাহিনীর প্রতিও ছিল তার অগাধ ভালোবাসা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কাল রাত্রিতে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা যখন বাংলার জনগণের উপর ঝাপিয়ে পড়ে, হামলা চালানো হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, একজন পুলিশও সেদিন মাথা নত করেনি। তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন হানাদার বাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে। এই দেশ স্বাধীন করার জন্য পুলিশের অবদান কম ছিল না। ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’ এই কনসেপ্ট সবার ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশকে সোনার দেশ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্নের বিভোর চোখ দুটিকে চিরতরে বন্ধ করে দেয় নরপিশাচরা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংগঠিত হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত অধ্যায়। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সবাইকে।
কবি সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক রাশেদ রউফ এর গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘দশ দিগন্তে বঙ্গবন্ধু’ এক মলাটে বাঁধা একজন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের ইতিহাস পরিপূর্ণরূপে জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বঙ্গবন্ধুকে জানার জন্যে এই গ্রন্থ অনন্য ভূমিকা রাখবে। যে জাতি দেশের ইতিহাস জানেনি, সে জাতির দেশপ্রেম কখনোই গভীর হয় না। বাংলাদেশকে জানতে হলে, জানতে হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
এই গ্রন্থটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, লাইব্রেরি, ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখা উচিত বলে আমি মনে করি।
[লেখক : গল্পকার। সম্পাদক, অনন্যধারা]