বাংলা ছড়ার জন্ম পরিচয় উন্মোচন করতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হয়, হাজার বছরের অতীত লোকালয়ে। আবহমান বাংলার লোকালয়ই ছড়ার উৎসমুখ। কখনো আনন্দ উল্লাসে, কখনো উত্তেজনায়, কখনো ব্যঙ্গ-কৌতুকে মুখে মুখে তৈরি হতো এক একটা ছড়া। গাওয়া হতো সুরে সুরে, আবেগে উচ্ছ্বাসে।
ছড়ার উৎপত্তি নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ছড়া ছিল একটি মৌখিক ও লৌকিক ঐতিহ্য। তা লেখা হতো না, কেবল গাওয়া হতো। লোকমুখে প্রচলিত বা লোকসাহিত্যের এসব ছড়াকে সংগ্রহ করে সর্বপ্রথম লৈখিক রূপ দেন বাংলা ছড়ার প্রাতঃস্মরণীয় পুরুষ যোগীন্দ্রনাথ সরকার। তিনি ১৮৯৯ সালে এসব সংগৃহীত ছড়াকে ‘খুকুমনিদের ছড়া’ শীর্ষক একটি গ্রন্থে সংকলিত করেন। সেই গ্রন্থের ভূমিকায় ছড়াকে প্রথমবারের মতো সাহিত্যের বিষয় বলে উল্লেখ করেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। এরপর প্রকাশিত যোগীন্দ্রনাথ সরকারের মৌলিক ছড়ার বই ‘হাসিরাশি’ (১৮৯৯)। এ কালের জনপ্রিয় ছড়াশিল্পী লুৎফর রহমান রিটন (১৯৬১-) সেই যোগীন্দ্রনাথ সরকারের যোগ্য উত্তরসূরিদের একজন; যিনি বাংলা ছড়া সাহিত্যের চিরায়ত অনুষঙ্গ ও আবহকে ধারণ করে চিরন্তন ধারাকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে পালন করছেন অগ্রণী ভূমিকা। ছড়ার সাথে যাঁর রয়েছে অন্তরের যোগ। আপাদমস্তক ছড়াকার বলে তিনি শয়নে স্বপনে জাগরণে শুধু ছড়াই দেখেন। তাঁর হাতের মুঠোয় অনায়াসে এসে ধরা দেয় অপূর্ব সব ছড়া। বিষয়ে, ভঙ্গিতে, শব্দে তিনি অনন্য। ছোটোদের ছড়া, বড়দের ছড়া, রাজনৈতিক ছড়া – বিভিন্ন ধরনের ছড়া লিখে তিনি রীতিমতো পরিণত হয়েছেন তারকায়। জাদুকরি ক্ষমতাগুণে তিনি আদায় করে নিতে পেরেছেন পাঠকের ভালোবাসা ও আলাদা রকমের সমীহ।
১৯৭২ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের কচি কাঁচার আসরে একটি ছোট্ট ছড়া প্রকাশের মাধ্যমে লুৎফর রহমান রিটনের আত্মপ্রকাশ। সেই থেকে তাঁর সুদূর পথ চলা; শুধুই এগিয়েছেন সামনে, পেছনে ফিরে তাকাবার আর কোনো অবকাশ তিনি পাননি। তিনি ছুটেছেন, শ্রম দিয়েছেন, সময় দিয়েছেন; ফলে সফলতা এসে ধরা দিয়েছে তাঁর হাতের মুঠোয়, খ্যাতি এসে লুটোপুটি খাচ্ছে তাঁর আঙিনায়। বাংলা ছড়া সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে ‘অসামান্য কীর্তিমান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘রিটনের ছড়ার বইগুলো আমি পড়েছি। তাঁর ছড়া লেখার হাত বিশেষ প্রশংসনীয়।’ বয়সের তুলনায় তাঁর সৃষ্টি প্রাচুর্য যেমন উল্লেখযোগ্য, তেমনি আকর্ষণীয় ও বিস্ময়কর হচ্ছে তাঁর রচনাশৈলী। ১৯৯৮ এর ফেব্রুয়ারিতে ‘ছড়াসমস্ত’ প্রকাশের মাধ্যমে লুৎফর রহমান রিটন তাঁর অগ্রগামিতা, অসাধারণত্ব ও অভিনবত্বের কথাই প্রমাণ করেছেন। ছড়াসাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর অভিযান সম্ভবত এই প্রথম।

২.
ছড়া হচ্ছে কার্টুনের মতো। দু’চার কথায় সত্য উচ্চারণ। ছন্দের টুং টাং ধ্বনি, শব্দের ঝংকার এবং সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ। সাধারণ মানুষের ভাষাকে অবলম্বন করে এগিয়ে যায়। এজন্য ছড়া হওয়া চাই স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক।
“হ্যান করেংগা ত্যান করেংগা
পিটিয়ে ছাগল ‘ম্যান’ করেংগা,
তালের পাখায় ফ্যান করেংগা।
দেশকে স্বপ্নপুরী করেংগা
অপরের খেয়ে ভুঁড়ি করেংগা
বাঁয়ে ঘোরাঘুরি করেংগা
দিনে দুপুরেই চুরি করেংগা।
ঘোড়া মারেংগা হাতি মারেংগা
হকি ইস্টিক ছাতি মারেংগা
শত্রু এবং সাথী মারেংগা
পেলেই সুযোগ লাথি মারেংগা।
প্রয়োজনে প্রাণ দান করেংগা
দেশের সেবায় গান করেংগা,
দু’চোখের জলে স্নান করেংগা
গুছিয়ে আখের রান করেংগা।
হ্যান করেংগা ত্যান করেংগা
স্বার্থবিহীন ক্যান করেংগা?
এই ছড়াটিতে যেমন আছে স্বতঃস্ফূর্ততা, তেমনি আছে ব্যঙ্গাত্মক রূপ। একটা পরোক্ষ খোঁচা রয়েছে ছড়াটির মধ্যে। আসলে লুৎফর রিটন প্রায় সবসময় তুলে আনতে চেষ্টা করেন সমাজের ছোট বড় অসঙ্গতি। তাঁর ছড়া শুধু আমাদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। ছন্দের ঝংকারে, বাকচাতুর্যে, ব্যঙ্গাত্মক পরিবেশনে তাঁর ছড়াগুলো হয়ে ওঠে আকর্ষণীয়।
‘আবদুল হাই। করে খাই খাই। এক্ষুণি খেয়ে বলে কিছু খাই নাই।’ এ ছড়াটিতে দেখা যায় আবদুল হাই অনেক কিছুর সাথে টিভি প্রোগ্রাম খায়, হাসি খায়, খুশি খায়, গাড়ি খায়, বাড়ি খায়, পুলিশের ফাঁড়ি খায়, লাথি খায়। এই ‘খাই খাই’ ভাবের মধ্যে ছড়াকার সমাজের কিছু চরিত্র তুলে ধরেছেন, যা সুন্দর উপস্থাপনা গুণে পেয়েছে অসামান্য রূপ।
এরকম অনেক ছড়ার উদাহরণ দেয়া যায়। যেমন :
খাঁচার ভেতর মোরগ ডাকে-কক
উচিত কথা শুনতে লাগে টক।
চাইলে খাবে ইলেকট্রিকের শক।
(উচিত কথা)
ওরা – পিঠে বেঁধেছে কুলো
এবং – কানে দিয়েছে তালা
ওদের গলায় আর ফুল নয়
এবার জুতোর মালা….।
(ওরা)।
‘ঢাকা আমার ঢাকা’ তাঁর অন্য একটি ছড়া। একটি গ্রন্থ। এই ছড়াটিতে উঠে এসেছে ঢাকার রূপ, বৈশিষ্ট্য ও অসঙ্গতি। কৌতুকের বক্রতায় ও অভিনব অন্ত্যমিলের কারণে ছড়াটির প্রতিটি অংশ পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করতে সক্ষম।
ঢাকার শহর আটার শহর
মাসকো এবং বাটার শহর
বিআরটিসি টাটার শহর
ওভারব্রিজে হাঁটার শহর ঢাকা।
—————————
—————————
ঢাকার শহর টাকার শহর
মার্সিডিজের চাকার শহর
স্বপ্ন শুধু আঁকার শহর
মরেও বেঁচে থাকার শহর ঢাকা।

লুৎফর রহমান রিটন একজন রাজনীতি সচেতন লেখক। সমকালীন ছড়া রচনায় তিনি পটু। সামরিক শাসন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, রাজাকার বিরোধী আন্দোলন ইত্যাদিতে তিনি মিটিয়েছেন সময়ের দাবি। ছড়ার ক্ষমতা কী এবং কোথায় -তা তিনি দেখিয়েছেন রাজনীতির অসংখ্য মঞ্চে। বক্তব্যের তাৎক্ষণিকতা ও অকৃত্রিম সুরের নিটোল ধ্বনিতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। সকল লেখকই সমকালীন এই রূপকে ধারণ করতে পারেন না। অনেক সময় সরাসরি বক্তব্য লেখার শিল্পগুণকে নষ্ট করে বলে এ ধরনের লেখাকে বুদ্ধদেব বসু ‘পদ্য-সাংবাদিকতাকেও’ তিনি স্থান দিয়েছেন সাহিত্যে। বলেছিলেন : ‘সাংবাদিকতা শুধু পদ্যে নয়, গদ্যেও কখনো কখনো সাহিত্যের এবং স্থায়ী সাহিত্যের আসন পেয়েছে। ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত অত্যন্ত বিরল নয়। Í কোনো সাংবাদিক রচনা সাহিত্যের স্তরে পৌঁছলো কিনা, সেটা যাচাই করার একটা উপায় হলো নিজেকে এই কথা জিজ্ঞাসা করা যে লেখটা আমার যে ভালো লাগলো তা তথ্যের জন্যে, না মতের জন্য, না রূপের জন্যে। মনে মনে যদি এ কথা বলি যে লেখাটা যেমনই হোক, যেটা বলতে চাচ্ছে, সেটা খুব ভালো কথা। তাহলে তাকে আর যা-ই বলি সাহিত্য বলা চলে না। আর যদি মনে হয় যে লেখক ভুল বলছেন, তাঁর কথা মানি না, কিন্তু লেখাটা ভালো লাগলো, তাহলেই বুঝতে হবে যে, সাহিত্যের শক্তি তার মধ্যে কাজ করছে। আর যদি উভয়কে পাওয়া যায় একই সঙ্গে, তাহলে তো কথাই নেই। কিন্তু সেখানেও আমরা এ বিষয়ে অবহিত হবো যে যেটা ভালো লাগছে এবং যার জন্য ভালো লাগছে, সেটা মত নয়, তথ্য নয়, সেটা রূপ।’
লুৎফর রহমান রিটনের গুটিকয়েক ছড়া বাদে বেশির ভাগ ছড়ায় যেমন মত আছে, তথ্য আছে, তেমনি আছে সৌন্দর্য। ঐ মত হয়তো সবার পছন্দ হবে না, তবু তার রচনাটি ভালো লাগবে।
লোকটা ছিল বুদ্ধিজীবী
কামার কিংবা চাষী না।
একাত্তরের দালাল ছিল
খেলতো কতো তাসই না।
লোকটা সেদিন সভাপতির আসনে
জানিয়ে দিল সুচিন্তিত ভাষণে
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ না।
সমকালীন রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের কর্মকা- তাঁর ছড়ায় বিষয় হয়ে এসেছে বহুবার। তিনি তুলে ধরেছেন তথাকথিত রাজনীতিবিদদের চরিত্র। তিনি বলেছেন Í
পলিটিক্স মানে রাজনীতি নয়,
পলিটিক্স মানে ভাঁওতা,
পলিটিশিয়ান ডিম পেড়ে বলে
দুই চোখ বুঝে দাও তা।
আমরাও তাই দেই,
এবং দেখি উধাও ছানা
চোখের পলকেই।
(পলিটিক্স)

অথবা,
দিনের বেলায় ভাষণে তার
মঞ্চ কাঁপে, তোফা!
রাতের বেলা বঙ্গভবন
ইস্পিরিং-এর সোফা।
[নেতার প্রতিমূর্তি]

অথবা,
তিনি বললেন, তামাক সাজাও
আমরা সাজালাম,
তিনি বললেন, ঢোলক বাজাও
আমরা বাজালাম।
তিনি বললেন -চুপ!
আমরাও তদ্রুপ।
(জো হুকুম)
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকায় জড়িত ঘৃণ্য রাজাকার-আলবদরদের নিয়ে লেখা প্রতিটি ছড়ায় লুৎফর রহমান রিটনের দেশপ্রেম যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি প্রকাশিত হয়েছে ঘৃণিত চরিত্র।
ধর্মের খোলসেই
মুখটাকে ঢেকেছি
মৌ-লোভী মৌলবী
ফিটফাট থেকেছি।

যেইদিকে খান সেনা
সেই দিকে ছুটেছি
লাখ লাখ মা বোনের
ইজ্জত লুটেছি
(নিলর্জ্জ স্বীকারোক্তি)
কিংবা
রাজাকার আছে অনেক প্রকার
‘খুদে’ রাজাকার ‘ধাড়ি’,
কোনো লেটেস্ট মডার্ন
মুখে নেই টুপি দাড়ি।
সুটেড-বুটেড রাজাকার আছে
পাইপ থেকে ছাড়ে ধোঁয়া
নেংটি নেংটি রাজাকারগুলো
ইদানীং ওঁয়া ওঁয়া।
অন্যদিকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লিখেছেন অনেকগুলো ছড়া। সেগুলোতে জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
‘এক এক্কে এক-
শেখ মুজিবুর নামের আগে
জাতির পিতা ল্যাখ….’ বলে নামতার ঢঙে যে ছড়াটি তিনি নির্মাণ করেছেন, সেটি এখন মুজিব ভক্তদের মুখে মুখে।

সব ধরনের ছড়া লেখায় লুৎফুর রহমান রিটন স্বতঃস্ফূর্ত। এমন কোনো বিষয় নেই, যা তাঁর ছড়ায় আসেনি। এমন কোনো দিক নেই যে, স্পর্শ করেন নি। বেকার যুবকের করুণ ও দুঃসহ যন্ত্রণার ছবি এঁকেছেন তাঁর ‘একজন বেকারের আত্মকথন’ ছড়ায়।
দুখের নদীতে বান ডাকে আর
সুখের নদীতে ভাটা
বেকার জীবনে দুঃসহ ব্যথা
কপালে আমার ঝাঁটা।

পায়ের চাটিতো ক্ষয় হয়ে গেছে
চুলগুলো সব রুক্ষ,
আপনাকে ভাই কী করে বোঝাই
বেকারের কী যে দুঃখ।

আবশ্যক-এর ঠিকানা মাফিক
অনেক দিয়েছি ধর্ণা
কণ্ঠে সবারই অভয়ের বাণী
আমি যেন কারো পর না।
কিন্তু তবুও চাকরি জোটেনি
কপালের বুঝি জোর নেই,
বেকার জীবেন আঁধিয়ার রাতি
যুগ যুগ ধরে ভোর নেই।

আসলে বেকারের জীবনে কোনো ভোর আসে না, রাত্রিই জীবন – এই করুণ চিত্র তিনি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন তাঁর ক্যানভাসে। ‘সাংবাদিক’দের নিয়ে লেখা ছড়াটিও সুন্দর। পেশাগত দায়িত্ব পালন কতে গিয়ে সাংবাদিকদের যে সমস্যায় পড়তে হয়, তাদের জন্য ‘কাছে ও দূরে’ কোনো ব্যাপারা নয়,খবর শোনা মাত্রই যে ঘটনাস্থলে ছুটে যান তাঁরা; খুঁটিনাটি ত্রুটি-বিচ্যুতি কোনো কিছুই যে তাঁদের চোখ এড়ায় না – তা তুলে ধরেছেন ছড়ায়। বলেছেন : ‘–এসব কি তার দৃষ্টি এড়ায়? এড়ায় না তো কিচ্ছু/তাই তো বলি সাংবাদিকের বিকল্প নাম বিচ্ছুু।’
‘বাড়ি ভাড়া’ ছড়াটাতে প্রতিফলিত হয়েছে বাস্তব চিত্র। পুরনো বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়ি ভাড়া করার শত প্রচেষ্টার পর অবশেষে একটা ঘর পাওয়া গেল: ‘ভাড়া নিলাম খুপরি মতন/ছোট্ট দু’টি ঘর/হয়তো আগে ঘর দুটিতে থাকতো কবুতর।’ টিকটিকি, ছারপোকা, মশা আর তেলাপোকায় ঠাসা ওই ঘরটি এতই ছোট যে কিছু রাখা যায় না। তাই ছড়াকার বলছেন –
চেয়ার টেবিল কোথায় রাখি
কোথায় রাখি চুলো?
হাঁড়ি পাতিল-বই-পুস্তক
লেপ-কম্বলগুলো?

কোথায় রাখি খাট-চৌকি
আলনা-বাসন-বাটি?
বুদ্ধি করে শেষে কিনে
নিলাম শীতলপাটি।
এই পাটিতেই থাকা-বসা
লেখাপড়া-শোয়া
এই শহরে-ঘর পাওয়া কি
ছেলের হাতের মোয়া?

হাস্যরসাত্মক ছড়া রচনায় লুৎফর রহমান রিটনের জুড়ি নেই। তাঁর রয়েছে খেয়ালখুশির বিচিত্র জগৎ। ছড়ার বক্তব্যটাকে কৌতুককর করে উপস্থাপনার জন্য তিনি সব সময় সচেষ্ট। তাঁর এ ধরনের ছড়া পড়ে শুধু ছোটরাই নয়, বড়ারাও তৃপ্ত হন। অনাবিল আনন্দে ভরে ওঠে মন্ তাঁর ‘পাত্র সমাচার’, ‘হোটেলের বয়’ ‘ম্যাট্রিকে হ্যট্রিক’, ‘কুস্তি’, ‘খিদে’, ‘হামটি ডামটি’, ‘বাহাদুর’, ‘ভাল্লাগেনা’ প্রভৃতি ছড়া পড়ে আমরা অভিভূত হই। নির্মল আনন্দে, নির্ভেজাল খুশিতে আটখানা হই।
হাবু আর গাবু দুই জনে খুব দুস্তি
দিন নেই রাত নেই ধরে শুধু কুস্তি।
হাবু বেশ বড় সড়, গাবুটা তো পিচ্চি,
হেরে গিয়ে হাবু বলে, উৎসাহ দিচ্ছি।

বহুল পঠিত ছড়া এটি। হাবু বেশ বড়সড় হওয়া সত্ত্বেও যদি হেরে যায়, তাহলে সে বলে, আমি তো হারি নি। কেবল হেরে গিয়ে গাবুকে উৎসাহ দিলাম। চমৎকার কৌতুক। ছড়ার কৌতুককর কাহিনি ও মজার উপস্থাপনায় এটি হয়ে উঠেছে অনন্য।
এরকম আরেকটি ছড়া ঃ
প্যাঁচা বলে ব্যাঙা
যত্ত পারিস ভ্যাঙা।
ব্যাঙা বলল প্যাচা
যত্ত পারিস চ্যাঁচা।
বলব কী ভাই, ইয়ে
ওরা দুজন ঝগড়া করে
গানের গলা দিয়ে।
প্যাঁচার ক্যাসেট দশ-বারোটা
ব্যাঙার ক্যাসেট ডজন
পৃথিবীতে ওদের মতোন
গায়ক আছে ক’জন।
ছড়াটিতে নির্মল হাস্যরসের দিকটি মুখ্য মনে হলেও তার ভেতরে আছে একটি খোঁচা, আছে সমকালের সঙ্গীতাঙ্গনের অসঙ্গতির প্রতি সুতীক্ষè ব্যঙ্গ। প্যাঁচা এবং ব্যাঙাদের মতো অ-গায়কদের ডজনে ডজনে ক্যাসেট বের হওয়ার প্রতি একটি পরোক্ষ প্রতিবাদ। এরকম অন্য একটি ছড়া:
ঘুমান তিনি খাটের নিচে
সত্যি কথা নয়তো মিছে।
আলমারিতে সাজান ভাতের হাঁড়ি
ব্যাংকে জমা রাখেন বৌয়ের শাড়ি।
দেখলে পুলিশ মেট্রোপলিটন
গাইতে থাকেন পপ আধুনিক গান।
লুৎফর রহমান রিটন আয়ত্ত করেছেন শিশু মনস্তত্ত্ব। ফলে শিশুর স্বপ্ন-সাধ-ও প্রত্যাশার বিষয়গুলোকে রূপে-রসে-গন্ধে জীবন্ত করে তুলেছেন তাঁর লেখায়। শিশুর যুক্তিহীন অবাস্তব ও নিয়মহীনতায় জগতকে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন বলে তিনি পরিণত হয়েছেন শিশুদের প্রিয় কবিতে।

৩.

Dr Bosanquet তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ A History of Aesthetics গ্রন্থে বলেছেন, There is no definition of beauty which can be said to have met with universal acceptance.
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা সহজ বিষয় নয়। কারণ এটি আপেক্ষিক, একেক জনের কাছে একেক ভাবে ধরা পড়ে সৌন্দর্য। একান্তই বিমূর্ত ধারণা। মানুষের সৌন্দর্যচেতনা উঠে এসেছে তার সমাজ জীবন থেকে। মার্কস বলেছেন, ‘পারিপার্শি¦ক জগতে, জীবনে ও শিল্পে সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা মানুষ লাভ করেছে কর্মের মধ্য দিয়ে’। আসলে জীবন, জগৎ ও বিশ্বপ্রকৃতিকে কেন্দ্র করে যে নৈসর্গিক সৌন্দর্য উৎসারিত হয়, তা মানুষের একমাত্র সৌন্দর্য নয়; অন্যভাবেও সুন্দরের মুখোমুখি হওয়া যায়। সংগীত, চিত্রকলা, সাহিত্য প্রভৃতিকে অবলম্বন করে যে সৃষ্টিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়, সেটাই আসল সৌন্দর্য।
মানুষ মাত্রই সুন্দরের পূজারী। একটা সুন্দর বিকেল মানুষের মনকে রঙিন করে তুলতে পারে। ঝলমলে আকাশ করে তুলতে পারে মায়াময়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলতে পারি: আমি চঞ্চল হে আমি সুদূরের পিয়াসী’। মানুষের মন নানা সময়ে হয়ে ওঠে সুন্দরের অভিসারী। রবীন্দ্রনাথ যে সৌন্দর্য চেতনা গড়ে তুলেছেন তাঁর সৃষ্টিকর্মে, তা আধ্যাত্মিক ও নান্দনিক দৃষ্টিসঞ্জাত। তাতে মানবপ্রেম যেমন আছে, তেমনি আছে প্রকৃতিপ্রেম।
লুৎফর রহমান রিটন তাঁর ছড়ায় এঁকেছেন সুন্দরের প্রতিচ্ছবি। তাঁর ছড়া পাঠে অনুভূত হয় নান্দনিক আনন্দ। সৌন্দর্যকে তিনি নিজে সম্ভোগ করেছেন বলে পরিণত হয়েছেন তারকায়। পেয়েছেন পাঠকের ভালোবাসা ও ঈর্ষণীয় সাফল্য। বিষয়ে, ভঙ্গিতে, শব্দে, ছন্দে তিনি অনন্য। তাঁর রয়েছে জাদুকরী ক্ষমতা। ফলে সব ধরনের বিষয় এসে সহজভাবে ধরা দেয় তাঁর হাতে।
সাধারণত সাহিত্যে দুটি দিক থাকে। একটি বিষয়গত দিক বা কনটেন্ট এবং অন্যটি হলো রূপগত দিক বা ফর্ম। বিষয়গত ও রূপগত – উভয় দিকেই অন্বেষণ করতে হয় নান্দনিকতার। কোনো কোনো রচনায় বিষয়গত সৌন্দর্য থাকলেও রূপগত সৌন্দর্য থাকে না। কিন্তু লুৎফর রহমান রিটনের ছড়ায় বিষয়গত ও রূপগত সৌন্দর্য দুই-ই সমানভাবে বিদ্যমান। ‘কাইফা হালুকা’ শিরোনামে তাঁর একটি ছড়ার উল্লেখ করছি।
কাইফা হালুকা?কাইফা হালুকা?
যাচ্ছি ভালুকা যাচ্ছি ভালুকা
ভাতের বদলে পারলে আলু খা
কাইফা হালুকা! কাইফা হালুকা!
কাইফা হালুকে? কাইফা হালুকে?
মধু কে খেয়েছে? খেয়েছে ভালুকে।
ই-মেল করেছি খালা ও খালুকে
কাইফা হালুকে! কাইফা হালুকে!
কাইফা ঝমকা কাইফা ঝমকা
ইহারে ধমকা উহারে ধমকা!
মন্ত্রী কহিছে কম খা, কম খা
কাইফা ঝমকা কাইফা ঝমকা!
কাইফা ফারুকি কাইফা ফারুকি
এটাকে লটকা ওটাকে লটকা—-
টিভির টকশো ফুটিছে পটকা!
কাইফা ঝটকা কাইফা ঝটকা!

এই ছড়াটিতে ওঠে এসেছে সমকালীনতা। কৌতুকের বক্রতায় ও অভিনব উপস্থাপনায় ছড়াটি পাঠকের মনকে স্পর্শ করতে সক্ষম। এতে রঙ্গরস যেমন আছে, তেমনি আছে সৌন্দর্য। মন্ত্রীর কম খাওয়ার পরামর্শ ও টিভির টকশো প্রসঙ্গ অতিসাম্প্রতিক আলোচিত ঘটনা। এগুলোর ব্যঙ্গ-নিপুণ উপস্থাপনা খুবই বিস্ময়কর। এ ধরনের আরেকটি ছড়ার প্রসঙ্গ টানতে চাই। ছড়াটি এরকম:
হ্যান করেংগা ত্যান করেংগা
পিটিয়ে ছাগল ‘ম্যান’ করেংগা।
তালের পাখায় ফ্যান করেংগা
খামোকাই প্যান প্যান করেংগা।
দেশকে স্বপ্নপুরী করেংগা
অপরের খেয়ে ভুঁড়ি করেংগা
বাঁয়ে ঘোরাঘুরি করেংগা
দিন দুপুরেই চুরি করেংগা।
————————
প্রয়োজনে প্রাণ দান করেংগা
দেশের সেবায় গান করেংগা
দুচোখের জলে স্নান করেংগা
গুছিয়ে আখের রান করেংগা
ঘ্যান করেংগা ত্যান করেংগা
স্বার্থবিহীন ক্যান করেংগা?

ছড়ার স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক রূপ ফুটে উঠেছে এতে। মানুষের মুখের ভাষাকে অবলম্বন করে এগিয়ে গেছে এর শরীর। এতে ধরা দিয়েছে ব্যঙ্গাত্মক সৌন্দর্য। লুৎফর রহমান রিটন কখনো প্রত্যক্ষভাবে আবার কখনো পরোক্ষভাবে তুলে আনার চেষ্টা করেন সমাজের নানা চিত্র, ছোট-বড় অসঙ্গতি। তাঁর ছড়া শুধু আমাদের চোখ, কান ও কল্পনার উৎসুকতাকে তৃপ্ত করে না, কৌতূহলী করে তোলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। ছন্দের ঝংকারে, বাকচাতুর্যে ব্যঙ্গাত্মক পরিবেশনে তাঁর ছড়াগুলো হয়ে ওঠে অপূর্ব দ্যুতিময়, ঝলমলে ও আকর্ষণীয়।
সুকুমার সেন বলেছেন, ছড়ায় যেমন ভাববীজ আছে, বস্তুবীজও আছে। এই বস্তুবীজ আবার দু’প্রকার। যেমন: জড়বস্তু ও সজীব বস্তু। সজীব বস্তুর মধ্যেও আছে দুই প্রত্যক্ষ বিভাজন। ক. উদ্ভিদ জগৎ খ. প্রাণীজগৎ। লুৎফর রহমান রিটনের ছড়ায় এসব বিষয় উঠে এসেছে অনায়াসে, অকৃত্রিমভাবে। যেমন:
গিলিগিলি, গিলিগিলি এব্রা কা ডেব্রা
উল্লুক ভাল্লুক ডোরাকাটা জেব্রা।
হাঁউমাঁউ চাঁউমাঁউ ম্যাঁও ম্যাঁও পিল্লি
একলাভে টেকনাফে দুই লাফে দিল্লি
তারপর?তিন লাফে সৌদির মক্কা
ব্যাটে বলে বাক্কাস! ছক্কা রে ছক্কা!
গিলিগিলি গিলিগিলি এব্রা কা ডেব্রা
উল্লুক ভাল্লুক ডোরাকাটা জেব্রা ..

ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও কাজ করে ছড়াসাহিত্যিকের সৌন্দর্য চেতনা। ছড়ার ভাষার স্বতন্ত্র রূপ আছে, আছে এদিক-ওদিক। আশিস কুমার দে বলেছেন, ভাষাবিচার যতটা আমরা ভাষার সাহায্য নিয়ে করব, ততটাই অ-ভাষিক বাচন সেখানে ক্রিয়া করে। এমনকি ছড়া বলতে বয়স্করা যে অঙ্গভঙ্গি করে বিষয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেন শিশুমনে, সেখানে অঙ্গভাষা (gestue language or phatic communication)  এর অনিবার্য উপাদান। লুৎফর রহমান রিটন অনেক ছড়ায় শব্দ ও ভাষা প্রয়োগে দেখিয়েছেন অসামান্য কৃতিত্ব। চিরায়ত লোকসাহিত্যের অনুষঙ্গ ও আবহকে বুকে ধারণ করে তিনি ছড়ায় এনেছেন আধুনিক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ আবহ।
মহুয়া পালার শ্লোক: ‘কোথায় পাইবাম কলসি কন্যা কোথায় পাইবাম দড়ি/ তুমি হও গহীন গাঙ আমি ডুইব্যা মরি’

থেকে পাইবাম শব্দটি ধারণ করে লিখলেন অসাধারণ ছড়া তোমার বাড়ি যাইবাম। ছড়াটি এখানে তুলে ধরছি।
তোমার বাড়িত যাইবাম
খুব সমাদর পাইবাম
তুমি নতুন গামছা দিলে
সাবান দিয়া নাইবাম
তোমার বাড়িত যাইবাম।
তোমার বাড়িত যাইবাম
খুব সমাদর পাইবার
মুরগি পোলাও জর্দা পায়েস
গোস্ত রুটি খাইবাম
খাওয়ার পরে পান সুপারি
খয়ের চুনা চাইবাম
তোমার বাড়িত যাইবাম।
তোমার বাড়িত যাইবাম
খুব সমাদর পাইবাম
বিদায় বেলা ফিরতি গাঙে
একলা নৌকা বাইবাম
বেলা ডুবার আগে আগেই
ঘরত ফিরা আইবাম
তোমার বাড়িত যাইবাম।

এই ছড়ায় আঞ্চলিক ভাষারূপ বিদ্যমান। একটা অঞ্চলের কথ্যভাষা এতে ক্রিয়াশীল। ছড়াটির গতিবিধি এমনই সুদূরপ্রসারী যে, তা বাংলাদেশের এক জায়গায় রচিত হলেও সব জায়গায় বিস্তার করতে সক্ষম। এর কারণ ছড়াটির মধ্যে সর্বজনীন আবেদন আছে, যা তাকে দিয়েছে এক ব্যাপ্তি। আবার যখন তিনি লিখেন:
আজিমপুরের আজিম
লোকটা ভীষণ পাজিম
নীলক্ষেতে সে বিক্রি করে
লেপ তোষক আর জাজিম।
বাপ কী করে? বললে বলে
আমার বাবায় মাঝিম।

এখানে ‘পাজি’ -কে পাজিম এবং মাঝিকে ‘মাঝিম’ হিসেবে প্রয়োগের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে নতুন সৌন্দর্য। এ রকম বহু ছড়ার উদাহরণ দেওয়া যাবে, যেগুলোতে লুৎফর রহমান রিটন মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
শিশুবিষয়ক ছড়ার মূল উপজীব্য শিশু। তাতে যে প্রসঙ্গটি মনকে নাড়া দেয়, সেটি হলো শিশুর মনস্তত্ত্ব। শিশুর জগৎ লুৎফর রহমান রিটনের চেনা। ফলে তাদের ভালো লাগার বিষয়কে তিনি অবলীলায় তুলে ধরতে পেরেছেন ছন্দ-মাধুর্যে।
সূর্যমামা ভীষণ রাগী
চাঁদমামা খুব ভালো
সূর্যগরম আলো ছড়ায়
চাঁদটা নরম আলো।
খোকার প্রিয় সূর্যমামা
খুকুর প্রিয় চাঁদ
চাঁদ-সূর্যের কাছে সেটাই
আনন্দ-সংবাদ।
সূর্যমামা খোকার মামা
চাঁদমামাটা খুকুর
দুই মামারই বুকের মধ্যে
ভালোবাসার পুকুর।

তাঁর ছড়াগুলোতে বিস্ময় ও আনন্দ যেমন আছে, তেমনি আছে হাস্যরস। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ভাষায় : ‘বুদ্ধির দীপ্তিতে, সজীব রসিকতায়, স্বতঃস্ফূর্ততায়, বিস্ময়ের শক্তিতে তাঁর শিশু-কিশোর কবিতা আমাদের সময়ের অন্যতম সেরা উপহার। আমার অনুভূতি এ রকম যে সাতচল্লিশোত্তর বাংলাদেশের শিশুকবিতার ধারায় তিনি সবচেয়ে সফল কবি এবং বাংলাভাষার শিশুসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবিদের একজন। অন্যদিকে আবদুল গাফফার চৌধুরী বলেছেন, রিটন হচ্ছেন রাইটার অব টু-মরো। তিনি বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের জন্য যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তা আমরা কেউ করতে পারি নি।
ছড়া হওয়া চাই স্বতঃস্ফূর্ত – বলেছেন অন্নদাশঙ্কর রায়। তাতে কৃত্রিমতা থাকবে না। থাকবে বৈচিত্র্য। থাকবে অফুরন্ত সৌন্দর্য। ছন্দের টুংটাং ধ্বনি থাকবে, কারিগরি থাকবে, থাকবে অল্পকথায় সত্যকথন।
বাড়ি আছে হরেক রকম
তোমার বাড়ি আমার বাড়ি
সবার সেরা মামার বাড়ি
হোটেল আছে হরেক রকম
শোবার হোটেল খাবার হোটেল
সবার সেরা বাবার হোটেল।
পাগল আছে হরেক রকম
পাবনা রাঁচি ঢাকার পাগল
সবচে বেশি টাকার পাগল।
ছাগল আছে হরেক রকম
ভিনদেশি আর দেশি ছাগল
বাংলাদেশে বেশি ছাগল।

ছড়ার বিষয়বস্তু ছড়াটিকে দান করেছে অদ্ভুত সৌন্দর্য। এই টুকরো টুকরো চিত্র, অসংলগ্নতা ও গতি-প্রকৃতির মধ্যেই রয়েছে চির আনন্দের উৎসব।
লুৎফর রহমান রিটন একজন নির্ভেজাল ছড়াশিল্পী। মজার ছড়া, দুঃখের ছড়া, যুদ্ধের ছড়া, আন্দোলনের ছড়া, ব্যঙ্গ ছড়া, হাসির ছড়া- সব ধরনের ছড়া লিখে তিনি স্থাপন করেছেন নতুন দৃষ্টান্ত। ‘ছড়াসমস্ত’-এর প্রথম খ- এবং দ্বিতীয় খ- প্রকাশ করে তিনি ‘রিটন তু নে কামাল কিয়া ভাই/ ছড়ায় তোমার জুড়ি তো আর নাই’-অন্নদাশঙ্কর রায়ের সেই কথাটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বেলাল চৌধুরীর ভাষায় বলতে পারি – ‘ছড়া আর রিটন প্রায় সমার্থবোধক শব্দ এখন বাংলাদেশে। ছড়া বলতেই মনে আসে রিটনের কথা। আর রিটন বলতেই মনে আসে ছড়ার কথা।’

৪.
ছড়ার প্রধান অনিবার্য দিক হচ্ছে তার ছন্দ। প্রাণহীন শরীর যেমন মূল্যহীন, ছন্দহীন ছড়া তেমন অপাঠ্য । জীবনানন্দ দাশ তাঁর এক প্রবন্ধে কবিতা সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘অর্থ পরে বোঝা যেতে পারে, কিন্তু প্রথমে তার ধ্বনিবিদ্যুৎ।’ লুৎফর রহমান রিটনের ছড়ায় রয়েছে অপূর্ব ব্যঞ্জনা।
তাঁর ছড়ার সৌন্দর্যের অন্যতম বিশেষ দিক হলো ছন্দ। তাঁর ছড়ার ধ্বনি-মাধুর্য এতোই চমৎকার যে শোনামাত্রই তুষ্ট হয় আমাদের কান। তাঁর ছন্দ যেমন নিখুঁত, তেমনি সূক্ষ্ম। মধ্যমিলে, অনুপ্রাসে, অন্ত্যমিলে তাঁর অসাধারণত্ব ধরা দেয় তাঁর ছড়াগুলোতে। আহমাদ মাযহারের ভাষায়, রিটনের ছন্দনৈপুণ্য বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ কবিদের ছন্দ-সাফল্যের সঙ্গে তুল্য। অন্ত্যমিলের সাফল্য তার চেয়েও বেশি। অনেক কঠিন ও দূরাগত শব্দ, শব্দবন্ধ এমনকি বাক্যাংশ দিয়ে তিনি এমন সহজ-অনায়াসে অন্ত্যমিল দিতে সক্ষম যে পাঠককে অনেক সময়ই হতবাক হয়ে যেতে হয়।

তাঁর ছড়ার ধ্বনি-মাধুর্য এতোই চমৎকার যে, শোনা মাত্রই তুষ্ট হয় আমাদের কান। বৈচিত্র্যময় ছন্দের ভেতরেই তাঁর বাস। রীতিমতো খেলা করেন ছন্দ নিয়ে। তাঁর ভাষায় : ‘যেদিকেই তাকাই, আমি কেবল ছড়াকেই দেখি। ছন্দের টুংটাং দেখি। মিলের টুংটং দেখি। এসব টুংটং আর টুংটং আমাকে অবিরাম ছড়া লিখতে বাধ্য করে।’ তিনি অত্যন্ত ছন্দ সচেতন্ তাঁর ছন্দ যেমন নিখুঁত, তেমনি স্বত:স্ফূর্ত। ছড়ার কথা ও আবেগকে এমনভাবে ছন্দের সুতোয় গাঁথেন, যা এক কথায় অতুলনীয়। প্রতিটা পঙ্ক্তি টান টান বলে ছন্দের গতি থাকে ক্ষিপ্র। মধ্যমিলে, অন্ত্যমিলে ও ছন্দ প্রয়োগে তাঁর অসাধারণত্ব ধরা দেয় তাঁর ছড়াগুলোতে।
ছোট্ট মেয়ে লিজি
আঁকছে হিজিবিজি
নাক আঁকল
কাক আঁকল
ফুল আঁকল
দুল আঁকল
মুরগি ও তার ছানা আঁকল
দাড়িঅলা বুড়ো নানা আঁকল
মাথা আঁকল
ছাতা আঁকল
আরো আঁকল হাতি
হাতির পিঠে বসে আসে সলিমুদ্দির নাতি।
লক্ষণীয়, এই ছড়ায় ‘দাড়িঅলা বুড়ো’ পর্বে মাত্রা বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও ছন্দের খেই হারিয়ে যায় নি, সুরের ব্যাঘাত ঘটে নি। এখানে ছড়াকারের শক্তিই প্রকাশ পেয়েছে। আসলে ছন্দ এমন একটা জিনিস, যেখানে সকলেই ঐকমত্যে পৌঁছে না, বা পৌঁছতে পারে না। ছন্দ হচ্ছে কানের জিনিস। একেক জনের কানের শ্রবণ বৈশিষ্ট্য অন্য জনের থেকে আলাদা। একেক জনের কান একেক রকমের ধ্বনি পছন্দ করে। ফলে আবৃত্তির ভঙ্গির মধ্যে এতটা পার্থক্য ঘটে। কোনো কোনো আবৃত্তিকার খুব তাড়াতাড়ি আবৃত্তি করে, আবার কেউ কেউ করে খুব বেশি টেনে টেনে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছন্দ বিচার প্রবন্ধে লিখেছেন : কানেরও একটা শিক্ষার প্রয়োজন আছে, আর আবৃত্তি করারও অভ্যাস থাকা চাই। আমি কিন্তু কবিতা রচনার সময় আবৃত্তি করতে করতেই লিখি। এমন কি, কোনো গদ্য রচনাও যখন ভালো করে লিখব মনে করি, তখন গদ্য লিখতে লিখতেও আবৃত্তি করি। কারণ রচনার ধ্বনি সঙ্গতি ঠিক হল কিনা তার একমাত্র প্রমাণ হচ্ছে কান।
লুৎফর রহমান রিটন রাজত্ব করেন ধ্বনির রাজ্যের। তাই তাঁর ছড়ার ধ্বনি আমাদের কানকে প্রতি করে। তাঁর ছড়াগুলো এমনই যে সহজে পড়া যায়, আবৃত্তি করা যায়। প্রচলিত ছন্দের সূত্র ঠিক থাকলেও, মাত্রা পর্ব যদি অক্ষুণœ থাকলেও ছড়াটি যদি সহজে পড়া না যায়, তাহলে সেই ছড়া ব্যর্থ। কিন্তু রিটনের সবকটি ছড়ায় আছে সহজ প্রাণের অফুরন্ত উৎস। স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দে প্রচুর ছড়া তিনি লিখেছেন। এই দুই ছন্দে তিনি স্বত:স্ফূর্ত ও সাবলীল। মাত্রাবৃত্তে লেখা তাঁর কোনো কোনো ছড়া অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্যও পূরণ করতে দেখা যায়। যেমন :
হাবু আর গাবু দুই জনে খুব দুস্তি
দিন নেই রাত নেই ধরে শুধু কুস্তি।
হাবু বেশ বড় সড়, গাবুটা তো পিচ্ছি
হেরে গিয়ে হাবু বলে, উৎসাহ দিচ্ছি।
অথবা,
এক দল ছেলে আছে
এক দল মেয়ে
ওরা কেউ ভালো নেই
আমাদের চেয়ে
পথে ওরা বেড়ে ওঠে
পথেই ঘুমায়
কেউ খোঁজ রাখি নাকো
খায় কি না খায়।

আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, উপর্যুক্ত ছড়া দু’টো ছড়াকার লিখেছেন মাত্রাবৃত্তে কিন্তু সেগুলো অক্ষরবৃত্তেও পড়া বা গণনা করা যায়।
জুৎসই ও চমকপ্রদ অন্ত্যমিল তাঁর ছড়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কখনো কোনো সময়েই দুর্বল মিল চোখে পড়ে না। অপূর্ব অন্ত্যমিল সমৃদ্ধ কয়েকটি ছড়ার উদাহরণ দিচ্ছি।
“গালে হাত ঠ্যাস দিয়ে রাত দিন ভাসে সে
পিটপিট চোখ দু’টো মুদে রাখে আবেশে –
লটারিতে নির্ঘাত লাখ টাকা পাবে সে।”
অথবা
“রং তুলিতে ছোট্ট শিখা আঁকল ছাতা সড়ক গাছ
তাই না দেখে আম্মুমনির চক্ষু দু’টি চড়কগাছ।”
অথবা
পুতুল সোনার বউ হারিয়ে আমেনা
সকাল থেকে কাঁদছে শুধু, থামেনা
তাই না শুনে পামের বাড়ির রোজিনা
বল্ল, তোমার পুতুল হারায রোজই, না?
কোথায় রাখ পুতুল তুমি লুকিয়ে?
আমেনা কয়, জুতোর ভিতর ঢুকিয়ে।

৫.
লুৎফর রহমান রিটন একজন আধুনিক ছড়াশিল্পী। বাংলা ছড়াসাহিত্যে এক দুর্দমনীয় ও জনপ্রিয় নাম। আমীরুল ইসলামের ভাষায় : ‘প্রায় একক ক্ষমতায় আমাদের ছড়াকে তিনি জনপ্রিয় করেছেন। বক্তব্যের উপস্থাপনায় শব্দের সুনির্বাচনে, সুন্দর মিলের মুগ্ধতায়, ছন্দের পরম্পরায় তার ছড়াগুলো পেয়েছে সহজাত রূপ। তাঁর স্বতন্ত্রবোধ – তাঁর মৌলিকতা তাঁকে বিশিষ্টতা দান করেছে। । তাঁর ছড়াসমস্ত আমাদের মূল্যবান সম্পদ। আমরা তাঁর ছড়ার সৌন্দর্যের গান গাই।
আবদুল্লাহ্্ আবু সায়ীদ তাই বিনা দ্বিধায় -নিঃসংকোচে লিখতে পেরেছেন – “বুদ্ধির দীপ্তিতে, সজীব রসিকতায়, স্বতঃস্ফূর্ততায়, বিস্ময়ের শক্তিকে তাঁর শিশু-কিশোর কবিতা আমাদের সময়ের অন্যতম সেরা উপহার। আমার অনুভূতি এরকম যে, সাতচল্লিশোত্তর বাংলাদেশের শিশুকবিতার ধারায় তিনি সবচেয়ে সফল কবি এবং বাংলাভাষার শিশুসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবিদের একজন।”