গত ১৯-২১ শে সেপ্টেম্বর ২০১৯, চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত তিনদিন ব্যাপী ছোটোদের বইমেলা ও শিশু সাহিত্য উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সফল একটি বইমেলা সুন্দর ও সার্থকভাবে সম্পন্ন করার জন্য যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তাদেরকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।বিশেষ করে অনুষ্ঠানটির আয়োজক বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমীর প্রাণপুরুষ শ্রদ্ধেয় রাশেদ রউফ ভাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অনুষ্ঠানটির সবচেয়ে বড় সার্থকতা হলো এর প্রতিটি অধিবেশনে হলভর্তি দর্শকের উপস্থিতি। সাধারণত এই ধরনের অনুষ্ঠানে দর্শকের উপস্থিতি খুব একটা হয় না কিন্তু এই উৎসবে হল ভর্তি দর্শক উপস্থিত ছিল। অর্থাৎ অনুষ্ঠানটির নিখুত পরিকল্পনা ও সৃজনশীলতার জন্য উপস্থিত দর্শকদের ধরে রাখতে পেরেছে। দেশে শিশুদের বই পড়ার আগ্রহ সৃস্টির জন্য এ ধরনের উৎসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে বড়দের জন্য বইমেলার আয়োজন করা হলেও শিশুদের জন্য এই ধরনের বইমেলার আয়োজন করা হয় না। অথচ শিশুদের মধ্যে যদি একবার বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারি,তাহলে শিশুরা যখন বড় হবে তখন তারা নিজেরা বই পড়বে ও তাদের ভবিষৎ প্রজন্মকে বই পড়ার ব্যাপারে আগ্রহী করবে। তাই ছোটোদেরকে একবার বই পড়ার নেশা ধরাইতে দিতে পারলে তা হবে একটি মহৎ কাজ, যা উদ্যোক্তাদের সুদুরপ্রসারী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।
বর্তমান আধুনিক যুগে আমরা সবাই নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে খুব ব্যস্ত। এখন সমাজে স্বামী স্ত্রী দুজনে আর্থিক সচ্ছলতার জন্য সারাদিন ঘরের বাইরে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারে না।সেই জন্য সন্তানদের সাথে আমাদের এক ধরনের দূরত্ব তৈরী হয় এবং এক পর্যায়ে সন্তানেরা আমাদেরকে বুঝে না,আমরাও তাদেরকে বুঝি না।
শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষাটা শুরু হয় বাবা মার কাছে। বাবা মা একটা শিশুকে ৪-৫ বছর বয়স পর্যন্ত যা শিখাবে শিশুটি সারা জীবন তা মনে রাখবে।আগে মা বাবারা বাচ্চাদেরকে মুখে মুখে অনেক কিছু শিখাতো।বাচ্চাদের নিয়ে এদিক ওদিক বেড়াতে যেত,বাচ্চারা ও কৌতূহলী হয়ে অনেক প্রশ্ন করতো।এতে বাচ্চারা প্রকৃতিসহ অন্যান্য বিষয়ে অনেক কিছু শিখতো।এখন বাবা মায়ের ব্যস্ততার জন্য তা হয়ে উঠে না।আরো একটি গুর”ত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে,আগে আমাদের দেশে প্রায় প্রতিটি পরিবার ছিল যৌথ।যৌথ পরিবারে শিশুরা দাদা দাদি,নানা নানিসহ ঘনিষ্ট আত্মীয় স্বজনের কাছে অনেক মজার গল্প শুনতো। এখন আমরা যৌথ পরিবার থেকে বাহির হয়ে আলাদা থাকায় আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে শিশুদের গল্প শুনার বিষয়টি নাই বললেই চলে।আগে মায়েরা বাচ্চাকে খাওয়ার ছলে বা ঘুম পাড়ানোর ছলে রাজারানী, ভুতপ্রেতিœ,রূপকথা এবং দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প শুনাতো।এমনো দেখা গেছে, সকালে খাওয়ার ছলে করা গল্পের পুরোটা শুনার জন্য বাচ্চা দুপুর পর্যন্ত মায়ের পিছন পিছন ঘুরতো।অর্থাৎ বাচ্চার মধ্যে গল্প শুনার একটা আগ্রহ তৈরী হতো। যা বড় হওয়ার পর বই পড়ার অভ্যাসে পরিনত হতো।এখন বাচ্চাকে আমরা খাওয়াতে বসে একেবারে শিশু অবস্হায় কার্টুন ও মোবাইল দিয়ে অভ্যস্হ করে ফেলছি,ফলে তাদের মধ্যে পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠছে না।শিশুকালে তথ্য প্রযুক্তির অতি ব্যবহার শিশুদের ক্রমবিকাশে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসাবে কাজ করে।আমরা প্রযুক্তির ক্ষতিকর দিকটির প্রতি তেমন একটা গুর”ত্ব দিচ্ছি না।অথছ বিশ্বে তথ্য প্রযুক্তির বিষয়ে যারা পথিকৃৎ তারা তাদের সন্তানদের পরিমিত পরিমানে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করতে দেন।কারন ওনারা তথ্যপ্রযুক্তির কুফল সম্পর্কে ভাল করে জানেন।
আগে বাচ্চাদেরকে ছোটকালে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়ানো হতো,এখন থানা লেভেলেও বাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ানো হয়।বাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ানোকে আমরা এখন প্রেস্টিজিয়াস ইস্যু বলে মনে করি।ফলে বাচ্চারা ভাল করে বাংলা বলতে ও পড়তে পারে না এবং বাংলা ভাষার প্রতি এক ধরনের ভীতি ও দুরত্ব তৈরী হয়।এতে বাচ্চার বাংলায় পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠে না।অবশ্য দেশে এখন বাংলা মিডিয়ামের ভাল প্রাইমারী স্কুল নাই বললেই চলে।ভাল বাংলা মিডিয়াম স্কুলের অভাবে বাচ্চাকে আমরা শিক্ষা জীবনের শুর”তে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করাতে বাধ্য হচ্ছি।অথছ দেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের সর্বোচ্চ বরাদ্দ হচ্ছে প্রাইমারী শিক্ষা খাতে।এদিকে যদি আমরা একটু ভালভাবে নজর দিয়ে সরকারী প্রাথমিক স্কুলগুলোকে মানসম্পন্ন করতে পারি,তাহলে শিশুকে আবার আমরা বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াতে আগ্রহী হবো।এতে বাংলা ভাষার প্রতি বাচ্চাদের অহেতুক ভীতি দূর হবে ও বাচ্চারা আবারো বাংলা বই পড়তে আগ্রহী হবে।বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে পুরো পৃথিবী একটা গ্লোবাল ভিলেজ।অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বাচ্চাকে প্রযুক্তি থেকে দুরে রাখা যাবে না।কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের সুবিধাটা আমরা কাজে লাগাতে পারছি না।সারাক্ষন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বাচ্চারা প্রযুক্তির প্রতি একধরনের এডিকটেড হয়ে পড়ছে।এতে করে তাদের চোখ,কান ও মস্তিষ্কে বির”প প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়,দেশে প্রতিবছর শুধু ইন্টারনেট ব্যবহারে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়,যার প্রায় নব্বই ভাগ ব্যয়ই হয় ফেইসবুক ও পর্ণেোসাইট দেখতে।
সমাজে অস্হিরতার একটি বড় কারন হচ্ছে অবাধে ইন্টারনেট ব্যবহার।অথছ আমরা নিজেরাই বাচ্চাকে অবুঝ অবস্হায় ইন্টারনেট ব্যবহার শিখাইয়া দিচ্ছি।এতে বাচ্চার পড়ালেখার প্রতি একধরনের অনীহা দেখা দিচ্ছে।দেশে এখন ভারতীয় সিরিয়াল দেখার জন্য মহিলাদের মধ্যে একধরনের ক্রেজ তৈরী হয়েছে।আচ্ছা বলুন তো আপনি যদি টিভিতে ভারতীয় সিরিয়াল দেখে বাচ্চাকে পড়ার জন্য বলেন,বাচ্চা কি পড়বে? কখনো পড়বে না।তাই আগে আপনাকে বই পড়তে হবে, তারপর বাচ্চা আপনার দেখাদেখি বই পড়ার ব্যাপারে আগ্রহী হবে। মনে রাখতে হবে,আমাদের বাবা মায়েরা সহজ সরল জীবনযাপন করেও আমাদেরকে মানুষ করতে পেরেছেন।আর আমরা আধুনিক ও স্মার্ট হয়েও আমাদের সন্তানকে মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন মানুষ হিসাবে তৈরী করতে পারছি না।এটাই বোধহয় আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।