লালন সাঁই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক আধ্যাত্বিক সিদ্ধ পুরুষ। তিনি একাধারে একজন বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক। তিনি অসংখ্য গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। তাঁকে ‘বাউল-সম্রাট’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। আজ তাঁর ২৪৭ তম জন্মবার্ষিকী। এ জন্মদিনে শৈলী টিভি অনলাইন পত্রিকার পক্ষ থেকে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লালনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, কিন্তু নিজ সাধনাবলে তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের শাস্ত্র সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করেন। তাঁর রচিত গানে সেই জ্ঞানের পরিচয় পাওয়াা যায়। আধ্যাত্মিক ভাবধারায় তিনি প্রায় দুহাজারেরও অধিক গান রচনা করেন। তাঁর গান মরমি ব্যঞ্জনা ও শিল্পগুণে সমৃদ্ধ। সহজ-সরল শব্দময় অথচ জ্ঞান গম্ভীর।
লালন ফকিরের জন্ম হয়েছিল অত্যন্ত সাধারণ পরিবারে। তবে তার জন্ম, ধর্ম, বংশপরিচয় এবং জন্মস্থান দুটোই এক রহস্যের অন্তরালে লুকিয়ে আছে। কোনো কোনো গবেষক তাকে আবিষ্কার করেন হিন্দুর ঘরে আবার কেউ কেউ বলেন তিনি মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। লালন নিজেও এই রহস্যের কোনো সমাধান দিয়ে যাননি। তার নিজেরই কিছু গান ব্যাপারটিকে আরো রহস্যময় করে তুলেছে। ১৭৭২/১৭৭৪ সালের ১৭ অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। যদিও লালন শাহের জন্ম তারিখ ও সাল এবং জাতি বা সম্প্রদায় নিয়ে অনেক মতভেদ আছে।কারো মতে তিনি ১৭৭২ সালে আবার কেউ কেউ কেউ বলেন ১৭৭৪ সালে তার জন্ম হয়।
তার কাছে কোনো জাত ফাত ভেদাভেদ ছিলো না। তিনি গেয়েছেন: ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/ লালন কয় জাতির কি রূপ দেখলাম না এ নজরে।’ এরূপ সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিমুক্ত এক সর্বজনীন ভাবরসে সিক্ত বলে লালনের গান বাংলার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নিকট সমান জনপ্রিয়। তাঁর ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘বাড়ির কাছে আরশী নগর’, ‘আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে’ ইত্যাদি গান বাউল তত্ত্বসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
লালন ছিলেন একজন মানবতাবাদী সাধক। যিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সকল প্রকার জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গান রচনা করেছেন। তার গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ও অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে। তার গানগুলো মূলত বাউল গান হলেও বাউল সম্প্রদায় ছাড়াও যুগে যুগে বহু সঙ্গীতশিল্পীর কণ্ঠে লালনের এই গানসমূহ উচ্চারিত হয়েছে। গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম, তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেয়া হয়েছিল।
লালন ফকির ছিলেন একজন দার্শনিক। তাঁর গানের মধ্যে সন্ধান পাওয়া যায় এক বিরল মানব দর্শনের।
‘যা আছে ভাণ্ডে, তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে’ – এই ছিল লালনের আদর্শের দর্শন। বৈষ্ণব, বৌদ্ধ ও সুফিবাদের সংমিশ্রণে মানবগুরুর ভজনা, দেহ-কেন্দ্রিক সাধনাই লালন প্রদর্শিত বাউল আদর্শের মূলমন্ত্র।
লালন ফকির বিশ্বাস করতেন সব মানুষের মধ্যেই বাস করে এক ‘অচিন পাখি’। আর সেই মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায় আত্মসাধনার মাধ্যমে। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর লালন মৃত্যুবরণ করেন।