ক্ষুদিরাম দাস। ভাষা সৈনিক, শিক্ষাবিদ, গবেষক সর্বোপরি একজন মুক্ত মনের আধুনিক মানুষ। তাঁর জন্ম ১৯১৬ সালের ০৯ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার অবস্থিত বেলিয়াতোড় গ্রামে । তার পিতার নাম সতীশ চন্দ্র দাস এবং মাতা কামিনীবালা দেবী। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে তার ছোটবেলা কেটেছে। আজ তাঁর ১০৫ তম জন্মদিন। তাঁর প্রতি রইলো শৈলী টিভি অনলাইন পত্রিকার পক্ষ থেকে বিন¤্র শ্রদ্ধা।
তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ. পাস করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি কাব্যতীর্থ ও কাব্যরতœ পরীক্ষা পাস করেন। তিনি ১৯৪১ সালে বি.টি পরীক্ষা পাস করেন ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে। বিশ বছর পরে তিনি বাংলা সাহিত্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালযয়ের প্রথম ডি-লিট সম্মানে ভূষিত হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপক পদ পাওয়ার সময় তিনি ছিলেন মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের পক্ষে। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের আন্দোলনে তিনি ছিলেন পুরোধা। ১৯৬৩ সালে সরকারে অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের পরিকল্পনাকে সার্থক করতে এগিয়ে এসেছিলেন এবং কৃষ্ণনগর পৌরসভার শিক্ষা সমিতির সভাপতি হয়েছিলেন। বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির ওপর হামলা রুখতে তার সভাপতিত্বে ১৯৮৯ সালে বঙ্গ-ভাষা প্রসার সমিতি গঠিত হয়। এই সমিতির উদ্দেশ্য ছিল বাংলার সুস্থ সংস্কৃতি ও ভাষা সাহিত্যকে পূর্ব মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। বাংলার বুকে সমস্ত অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ, ব্যাংক, পোষ্ট অফিস ইত্যাদিতে বাংলা ভাষায় কাজকর্ম চালু করা। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তিনি মেট্রোসিনেমার সামনে জনসভায় বাংলা ভাষার স্বাধিকারের পক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে মহান একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের স্মরণে মিছিলে করেন। দূরদর্শনে বাংলা ভাষা ভিত্তিক অনুষ্ঠান কমিয়ে দেয়ার এবং হিন্দির আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কলকাতা দূরদর্শনের কেন্দ্র অধিকর্তার কাছে প্রতিবাদ জানাতে গিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনযাপনের দিক থেকে তিনি ছিলেন খুবই সাধারণ। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতায়, প্রগতিশীল চিন্তাচেতনায় প্রণিত আদর্শনিষ্ঠ সমাজ মনস্ক বুদ্ধিজীবী এবং নানা গঠনকর্মে নিষ্ঠায় আজীবন ব্রতী। সর্বপ্রকার সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামিমুক্ত মুক্তমনের আধুনিক মানুষ, মানুষের কাছে দায়বদ্ধ সামাজিক মানুষ। তার সম্বন্ধে কথাসাহিত্যিক প্রাজ্ঞ চিন্তানায়ক অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন ‘ডক্টর ক্ষুদিরাম দাস তার বিদ্যাবত্তার জন্য বিখ্যাত। যেমন সংস্কৃত তেমনি বাংলা উভয় ভাষায় তার অসীম অধিকার। তার চেয়েও প্রশংসনীয় লিখনশৈলী ও শব্দচয়ন । আমি তার বাংলা রচনার পক্ষপাতী পাঠক। তার চেয়েও প্রশংসনীয় তার মুক্ত মন। সংস্কারমুক্ত মনে তিনি ভারতের বিবিধ ভাষা অনুশীলন করেছেন। তিনি আবিষ্কার করেছেন যে বাংলা ভাষার অসংখ্য শব্দ এসেছে সাঁওতালি ভাষা থেকে। যাঁরা নিয়েছেন তারা সংস্কৃত দিয়ে শোধন করে মুখে তুলেছেন। বাংলাদেশ গোড়ায় ছিল আদিবাসীদের দেশ। তাদের ভাষার সঙ্গে সংমিশ্রণ সূত্রেই বাংলা ভাষার বিবর্তন ঘটেছে। ক্ষুদিরামবাবু সেই বিবর্তনের সন্ধান দিয়ে আমাদের অতীত সম্বন্ধে আমাদের সচেতন করেছেন’। তাঁর উল্ল্যেখযোগ্য গ্রন্থাবলীÑ‘ রবীন্দ্র প্রতিভার পরিচয়’(১৯৫৩), ‘বাংলা কাব্যের রূপ ও রীতি’(১৯৫৮),‘চিত্র গীতময়ী রবীন্দ্র বাণী’ (১৯৬৬),‘বৈষ্ণব রস প্রকাশ’(১৯৭২),‘সমাজ প্রগতি রবীন্দ্রনাথ’(১৯৭৩),‘রবীন্দ্র কল্পনায় বিজ্ঞানের অধিকার’ (১৯৮৪), ‘বাংলা সাহিত্যের আদ্য মধ্য’ (১৯৮৫) ‘ব্যাকরণ’ (৩ খ-), ‘বানান বানানোর বন্দরে’ (১৯৯৩),‘চোদ্দশ সাল ও চলমান রবি’ (১৯৯৩),‘দেশ কাল সাহিত্য’ (১৯৯৫)‘সাঁওতালি বাংলা সমশব্দ অভিধান’ (১৯৯৮), ‘বাছাই প্রবন্ধ (১৪ টি রচনার সংকলন, মানস মজুমদার দ্বারা সম্পাদিত) (২০০০), পথের ছায়াছবিতে অধ্যাপক ক্ষুদিরাম দাস (মানস মজুমদার দ্বারা সম্পাদিত) (১৯৯৬)।