আদিম যুগের মানুষ গাছের পাতা ও চট দিয়ে বস্ত্র তৈরি করে বস্ত্র পরিধান করতো। তবুও ছিল সভ্যতা, ছিল নম্রতা, ছিল মানুষ হিসাবে নিজেকে গণ্য করার প্রচেষ্টা। যত পরিবর্তন আসতে শুরু হলো তত আধুনিক ও আত্মকেন্দ্রিক জীবন। সময়ের বিবর্তনে আস্তে আস্তে সব পাল্টাতে শুরু করেছে। পাথর ঘসে ঘসে আগুন জ্বালানোর ব্যবহার শিখলো, গাছের পাতা দিয়ে পোশাক তৈরি শিখলো, বিভিন্ন গাছের ছালের রস থেকে জীবন বাঁচানো শিখলো। শিকারের কাঁচা মাংস খাওয়া থেকে রান্না করা শিখলো। কাঠের চিপ ও পাখির পালক দিয়ে লিখা শিখলো পাতায়। দিনের পর দিন মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সব প্রয়োজন ও পরিবর্তনের বদলৌতে বর্তমান। সবুজ কলা পাতা বা বট পাতা কে বাসন তৈরি করে খাবার খেতো তাই মনের মধ্যে সবুজ ও সহজেই মানুষকে বিশ্বাস করে বাঁচতে জানতো তারপরে আসলো মাটির থালা, বাসন হাঁড়িতে ব্যবহার মানুষ মানুষের সম্পর্কগুলো আপন জনের মধ্যে মাটির মতো সুন্দর ভাব আদান প্রদান করা হতো যৌথ পরিবারের সদস্যরা একে অপরের শক্তি ভালোবাসার সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে নিতো প্রতিদিন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেই থাকতে ভালবাসতো একজন আরেকজনের বাড়িতে, বাসায় নাইর আসতো
গ্রীষ্মের ছুটিতে, বার্ষিক পরীক্ষার পর, ভাদ্র মাসে ঈদের ছুটিতে পূজার ছুটিতে সবাই সবার খোঁজ খবর নেওয়া বেড়াতে আসা আনন্দের জোয়ার বয়ে যেত। মাটিতে বসে পাটিতে বা বড় থালাতে এক সাথে সবাই ভাগাভাগি করে খাওয়ার মধ্যে ছিলো হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা নিখুঁত সম্পর্ক। পরিবারের সবাই একসাথে বসে আডডা দেওয়া ছেলে অফিস থেকে বা বাহিরে থেকে ঘুরে ঢুকতেই মা বাবার খোঁজ খবর নেওয়া বাইরে বা অফিসে যাবার সময় মা কে বা মুরব্বিদের কে বলে ঘর থেকে বের হওয়া একটা নিয়ম বা দায়িত্ব ছিল ।
একসাথে একজন আরেক জনের জন্য অপেক্ষা করা , ছোট ছোট ভাই বোন এক সাথে সন্ধ্যার সময় হারিকেনের আলোয় লেখাপড়ায় ব্যস্ত থাকা, ঘুমের সময় জল পরী,ফুল পরী,রাক্ষসী, একযে ছিল রাজা রাণী ও পাতাল পুরের রাজকন্যা ও দৈত্য দানব এর গল্প শোনা হতো এক বিছানায় ঠাসা ঠাসি করে সবাই থাকা কতো মজার কতো আনন্দদায়ক দিন গুলো।
এতো সব রক্ষা করে চলা যৌথপরিবারের আকর্ষণ ছিল অকল্পনীয়। পুরো পাড়া বা পুরো বাড়িতে অথবা নিজ বাসায় সাদা কালো টেলিভিশন ছিল সবাই গোল করে বসে টিভি দেখার মজাই ছিল ভরপুর আনন্দ খুশি, টিভিতে কার্টুন ইসকুবিডু, টম এন্ড জেরি, সুন্দর সুন্দর নাটক, এবং যদি কিছু মনে না করেন, ইত্যাদি, ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠান, পুরানো দিনের ছবি, কয়েক টা মান সম্পন্ন সিরিজ ছিল, ডালাস,দ্যা এনক্ডিবল হক, বায়োনোকুমেন, চার্লস এনজেস, টারজান, এই সব দিন রাত্রি, সকাল সন্ধ্যা, সন্ধ্যায় গোল বৈঠক, পরিবার পরিকল্পনা অনুষ্ঠান আর রেডিওতে ছিল বিজ্ঞাপন তরঙ্গ। ছায়াছবির গান রেডিও তবে ও সুন্দর সুন্দর শিক্ষণীয় নাটকও ছিলো।
বায়োস্কোপ, নাগরদোলা, বলিখেলা, পুতুল নাচ, সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখাপরিবারের সাথে এটাই ছিল বিনোদন।
ঈদে একটা দুইটা জামাতেই ছিল বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দ, বছরের প্রথম বাৎসরিক পরীক্ষার পর স্কুল ড্রেস, নতুন বই খাতা নেওয়া, স্কুল ব্যগ জোতা কেনার মধ্যে আনন্দ ছিল নতুন বইয়ের গন্ধ টান ছিল আলাদা। টেবিলে সাজিয়ে রাখা উপরে নাম লিখে লিখে আর এখন লেখাপড়া হলো লেপটপে, ঈদের জামাতে নাই আনন্দ নাই সেমাই, দুই টা জামার পরিবর্তে দশটা জামা দামী দামী সব কিন্তু আনন্দ নাই আগের মতো। একটা গাড়িতে সবাই উঠে ঘুরা হতো বাড়ির লোকজনের বা আত্বীয় স্বজনের কারো দরকার হলে একটা গাড়িতেই আসা যাওয়া আর এখন একটা পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য গাড়ি আলাদা,রুম আলাদা, সবকিছু আলাদা ভোগ করার চিন্তা ভাবনা তেই দূরত্ব আরো আলাদাতেই তৈরি হলো।
এরপর কাঁসা পিতলের তৈরি করা থালা বাসন আসলো মানুষ মানুষের সম্পর্ক গুলো একদিনের বদলে এক সপ্তাহে /একমাস/ছয়মাস পরিনত হলো কাঁসা পিতলের মতো মনটা শক্ত হয়ে গেলো সম্পর্ক টাও পিতলের পাত্রের মতো হয়ে গেলো জঙ্গ আসতে শুরু হলো সব মায়া মমতা দূরে সরে যেতে লাগলো কেউ কাউকে সময় দেয় না নিজ পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে চিনে না পরিচিত নয়। কারো সাথে যোগাযোগ নাই বাড়তে লাগলো সামাজিক দূরত্ব মনের দূরত্ব । একজন আরেকজনের বাড়িতে বা বাসায় আসতে চাইলে সপ্তাহ আগে থেকেই বলে রাখতে হয় ছুটির দিনে আসতে হবে, কয়জন আসবে ইত্যাদি । টেবিলে একসাথে খাওয়া তেমন হয় না কারণ খাওয়ার সময় পরিবারের সদস্যদের একজনের সময় এক একটাই সময় কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে থাকে না সবাই স্বাধীন।
এতোটা স্বাধীন যে মমতা জড়ানো সময় টুকু ভেস্তেগেছে আধুনিকতার কাছে। নাই এখন দৈত্য দানব এর গল্প নাই আডডা, নাই কোন ঘুম পাড়ানী গান, এখন ভাত খাওয়ার সময় ছোট শিশুদের হাতে মোবাইল দিয়ে বিভিন্ন ইংরেজি গান ও কার্টুন ছবি দেখে দেখে খাওয়া মা বাবা অফিসে গেলে বাচ্চাদের কে বেবি সিটারে দিয়ে তারপর যাওয়া আগে থাকতো দাদা দাদী বা নানা নানীর কাছে।
এখন একই রুমে বসে আছে কিন্তু মুখে কোন গল্প নাই সবার চোখ মোবাইল এর মাধ্যমে মন্ত্র মুগ্ধের সাথে থাকা । আগের দিনে একটা টেলিগ্রাম বা একটা চিঠির জন্য কতো অপেক্ষা আর বর্তমান ঐ দরদী ভালোবাসা শুধু মাত্র মেসেজ, এর মধ্যে বা মোবাইল ফোন এ বন্দী খাঁচার ভিতর চলে গেছে। হারিকেনের মৃদু আলোর পরিবর্তে বড় বড় লাইট, বাতি, সাদা কালো টেলিভিশন এর পরিবর্তে বড় বড় রঙিন টিভি বড় পর্দায় হাজার টা বিদেশি চ্যানেল বর্তমানে সব হারিয়ে গেছে প্রযুক্তির কল্যাণে।মায়া মমতাও কম খরচেই সাশ্রয়ী হয়ে গেল। তারপর আসলো সিরামিক ও কাঁচের পাত্রের তৈরি করা সব তারপর থেকে শুরু হলো সম্পর্ক টা ঠুনকো কাঁচের মত পান কষতেই চুনের দাগ অল্প সময়েই সম্পর্কে ফাটল ধরা কিছু হলেই ভেঙে ফেলা। ইগো প্রবলেম ছোট বড় ভেদাভেদ। চাকচিক্যের মধ্যে ভালো মন্দ বিচার। আর বর্তমান হলো ওয়ান টাইম কাগজের তৈরি সব একবার ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া – এখন জীবন টা বুফে খাওয়া আত্মকেন্দ্রিক হাতে হাতে নিয়ে খেয়ে ওয়ান টাইম কাগজের প্লেট ছুড়ে ফেলা।
মানুষ মানুষের সম্পর্ক ঠিক তাই। নিজের কাছের মানুষকেই চিনেন না বাবা বা মায়ের কাছের আত্মীয়কেই মনে করে অহেতুক এসব । মা বাবাকে নিজের কাছে রাখা মানেই সন্তানদের বোঝা টানার মতো বৃদ্ধা আশ্রম রেখে আসা। পরিত্যক্ত ফার্নিচারের মতো
আধুনিক পদ্ধতিতে সংসার ও সামাজিকতা। সময় বাঁচানো ডিজিটাল যুগ বছরের পর বছর শেষ তবুও দেখে না সন্তান মা বাবার মুখএকই ভাবে বাবা মা আত্মীয় স্বজনের সাথে হয় না দেখা নিঃসঙ্গ জীবন ব্যসত শহর কোলাহল ছাড়া মায়া ত্যাগ করা জীবন যাপনে একা। আমরা তলিয়ে যাচ্ছি এড়িয়ে যাচ্ছি সব!