সুবর্ণা দাশ মুনমুন আমাদের শিশুসাহিত্য অঙ্গনে এক পরিচিত মুখ। আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন এই লেখক লেখালেখি করছে অনেক দিন ধরে। তার প্রথম লেখা প্রকাশ ২০০১ সালে দৈনিক আজাদীতে। নানামুখী লেখা লিখে নিজের পরিচিতির বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হয়েছে অনায়াসে। সাহিত্যের অপরাপর শাখায় স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ সত্ত্বেও একটা জায়গায় এসে সে তার অভিনবত্ব প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছে। সেই জায়গাটি হলো ‘কিশোরকবিতা’। অল্পসময়ে সে পৌঁছে গেছে কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে। প্রথম বই ‘পাখির ডানায় মন’ লিখে আমাদের মনের মধ্যে প্রবেশ করেছে সে। এরপর বেরোলো তার দ্বিতীয় কিশোরকাব্য ‘হাওয়া গান ঝিরঝির’। বইটার ভেতরে যে কবিতাগুলো স্থান পেয়েছে, এককথায় চমৎকার। তার কবিতায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের প্রকৃতি এবং কিশোর মনের হাসি-আনন্দ ও কষ্ট-হাহাকার। প্রকৃতির বর্ণনায় তার স্বতন্ত্র প্রয়াস বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। কবিতাগুলোর মাধ্যমে সুবর্ণা দাশ মুনমুন বৈচিত্র্যসন্ধানী লেখক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।
‘হাওয়া গান ঝিরঝির’ বইয়ে মোট ২০টি কবিতা স্থান পেয়েছে। ছোটোদের মনের মত করে সহজ সরল ছন্দে, দৃশ্যময় ভাষায় সে নির্মাণ করেছে অপূর্ব সব কবিতা। বক্তব্যের সাবলীলতায়, সহজবোধ্য প্রকাশে, ছন্দ নৈপুণ্যে সে জয় করে নিয়েছে ছোটোদের মন। এমনকি বড়দের মনও। তার ছন্দ ঢিলেঢালা নয়, টান টান ও গতিময়। ছন্দের গতি ও বক্তব্যের সংহতি তার রচনাকে বিশেষত্ব দান করেছে।

সারাদিন ফিসফিস ভোরটা কী চঞ্চল
উড়ু উড়ু মেঘে চড়ে যাবি যদি মন চল।
কিংবা,
টুপটুপ দেয় ডুব পানকৌড়ি -নীলশির
আমলকী বনে চলে হাওয়া গান ঝিরঝির।

মজার বিষয়, সে জেনে হোক আর না জেনে হোক- সে ছন্দের রীতি-নীতি ও কৌশলকে কোথাও কোথাও ভেঙে আমাদের অবাক করে দিয়েছে। হয়তো সেটা তার মনের অজান্তে, হয়তো তার স্বভাবজাত। যেমন :

ঝিরঝির বৃষ্টি ঝরে যায় ধীর পায়
ধান শিশু, বুনো হাওয়া তার পিছু পিছু ধায়।

এখানে ‘বৃষ্টি’ পর্বে মাত্রাঘাটতি অনেকের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। রক্ষণশীলরা এখানে ছন্দের ভুল ধরতে চাইবেন। কিন্তু ছন্দের গতি এখানে ঠিক থাকায় তেমন কোনো সমস্যা হয় না।
নিজের মতো করে ছন্দের স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে নিয়েছে তার কবিতার শরীর। তার ভাষা যেমন সহজ ও প্রাঞ্জল, প্রকাশভঙ্গিও তেমনি অপূর্ব।
ছোটোদের মনের মত করে সহজ সরল দৃশ্যময় ভাষায় লেখা কবিতা যে সব বয়সের পাঠককে আকর্ষণ করতে সক্ষম, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ সুবর্ণা দাশ মুনমুনের কবিতা। এ সমস্ত কবিতায় পাঠকরা যেন নিজেদেরই খুঁজে পায়। নিজেদের মনের কথাগুলি ছন্দে সুরে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। কয়েকটি পংক্তির কথা এখানে তুলে ধরতে চাই। যেমন :

এক ক্ষুদিরাম, একটা সালাম কিংবা সূর্যসেন
একটা সূর্য কিনতে গিয়ে আকাশ টা কিনলেন।
[সাতনরি হার বাংলা আমার]

হিম কুড়োনি মেয়ের চুলে জ্যোৎস্না কাটে বিলি
রুপোর থালায় পিছলে পড়ে আলোর ঝিলিমিলি।
[হিম কুড়োনি মেয়ে]

মেঘের ভেতর জলের উঠোন পাখির চোখে ঘুম
হেলেঞ্চাদের কপাল ছুঁয়ে শিশির পরায় চুম।
[মেঘের ভেতর জলের উঠোন]

মুক্তি এলো পৌষ সকালে লাল সবুজ এক খামে
শিশির কণঅয় গা ভেজানো বাংলাদেশের নামে।
[বাংলাদেশের নামে]

সুবর্ণা দাশ মুনমুনের অধিকাংশ কবিতার মধ্যে পাওয়া যায় নির্ভেজাল আনন্দ, নির্মল সারল্য ও অকৃত্রিম সৌন্দর্য। ছোটোরা যেমন সতেজ, সবুজ, প্রাণবন্ত; তেমনি তার কবিতাও সতেজ ও সপ্রাণ। এখানে ফুটে উঠেছে স্বদেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, প্রকৃতি-চেতনা ও ছোটোদের প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা।
‘হাওয়া গান ঝিরঝির’ প্রকাশ করেছে শৈলী। মুদ্রণ তত্ত্বাবধানে ছিল আইকো। প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী উত্তম সেন। অলংকরণ নাটু বিকাশ বড়ুয়া। দাম রাখা হয়েছে ২২০ টাকা। সব মিলিয়ে একটা চমৎকার বই উপহার দেওয়ার জন্য আমি সুবর্ণা দাশ মুনমুনকে অভিনন্দন জানাই।