‘সংস্কৃতি’ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি যে কোন জাতির শেকড় এবং যে কোনো জাতি ও সমাজের দর্পণ স্বরূপ। এটি কোনো সুনির্দিষ্ট সমাজের ভিতরে প্রচলিত এমন একটি সমন্বিত জীবন-প্রণালী, যা দীর্ঘ দিনের অনুশীলনের ভিতর দিয়ে সংস্কারকৃত দশায় সমাজের প্রতিটি সদস্য চর্চা করে এবং মান্য করে। সংস্কৃতিই হলো কোনো সুনির্দিষ্ট সমাজের স্বাতস্ত্র্য ও মৌল বৈশিষ্ট্য বহনকারী উপাদান। এই উপাদানের মধ্যে নিহিত রয়েছে ঐ সমাজের স্বীকৃত প্রথাগত আচরণ, ভাষাশৈলী, শিল্পকলা নীতিবোধ, আইন ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য সমূহ। যে কোনো সমাজ এই বৈশিষ্ট্য সমূহ ধারণ করে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তা সঞ্চালিত করে। নীতিগত বিশ্বাস আর পরিমার্জিত মন মানসিকতার নামই সংস্কৃতি। তাই সুস্থ সংস্কৃতি জাতির প্রাণ শক্তিকে সৌন্দর্যম-িত ও পরিপুষ্ট করে তোলে। জীবন ও সংস্কৃতি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। সংস্কৃতি আমাদের জাগতিক নৈপুণ্য ও কর্মকুশলতা দান করে, আশা-আকাঙক্ষা জাগ্রত করে, আমাদের মূল্যবোধকে সদা উন্নত রাখে। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমেই কেবল আলোকিত মানুষ গড়া সম্ভব। সংস্কৃতির মূল উদ্দেশ্য হলো সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা। সংস্কৃতির অর্থই হচ্ছে সংস্কার বা বিশুদ্ধকরণ। সমাজের সব অসত্য-অন্যায় অনাচার এবং কুসংস্কার দূর করে সত্য ও সুন্দরের চর্চা করা সংস্কৃতির লক্ষ্য। সংস্কৃতি এক চলমান ধারা, নদীর মতো বহমান এর গতি। সংস্কৃতি হাঁটে তার নিজস্ব তত্ত্বে। মানুষই এর ধারক এবং বাহক। সকল প্রকার অপশক্তিকে প্রতিহত করার অন্যতম উপায় হলো সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা। বৈচিত্রে পরিপূর্ণ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের শেকড় সংস্কৃতি ছাড়া দেশের ইতিহাস পূর্ণতা দাবী করতে পারে না। আমাদের দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হলে তার গ্রামীণ মানুষ, তার ভাষা, সাহিত্য, লৌকিক শিল্প, প্রকৃতি এবং গ্রামীণ সমাজকে বাস্তব দৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন করতে হবে। আমাদের নৃত্য, আমাদের আঞ্চলিক গান, আমাদের নাট্যশালা, চারুকলা, শিল্পকলা, আমাদের জাতীয় শহিদ মিনার, ছায়ানট, আমাদের পহেলা বৈশাখ,আমাদের জাতীয় দিবস– এইগুলোর মধ্যে আমরা সংস্কৃতিকে লালন করি এবং চর্চা করি। মানুষের প্রতিদিনের জীবনাচরণ অর্থাৎ চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, উৎসব-আনন্দ, হাসি-কান্না, বিনোদন, পূজা-অর্চনা, প্রার্থনা এই সব কিছুই সংস্কৃতির বসবাস। সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চা সমাজকে সত্য, সুন্দর ও আলোর পথ দেখায়। সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল এবং এতে নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হয়। এই নতুন উপাদান গুলো পুরাতন উপাদান গুলোর সাথে সমন্বয় করে। যদি নতুন উপাদান গুলো কোনো সমাজের মূল্যবোধের সাথে সমন্বিত না হয়ে বিকৃত বা বিপর্যস্ত হয়ে সমাজে বিরাজ করে তখন তা আর সুষ্ঠু সংস্কৃতি থাকেনা। সেটি অপসংস্কৃতি বলে বিবেচিত হয়। অপসংস্কৃতি আমাদের মনকে কলুষিত করে, আমাদের সভ্যতার অবনতি ঘটায়, জীবনকে বিপর্যস্ত করে, মূল্যবোধকে ধ্বংস করে, যুব সমাজকে আদর্শচ্যুত করে, দেশ ও মাটির প্রতি প্রেম জাগ্রত করেনা। একজন মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য নিজের সংস্কৃতিকে জানতে হবে, চর্চা করতে হবে। একজন মানুষ শিশুকালে স্কুলে কিংবা বাবা-মায়ের হাত ধরে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায়, জাতীয় দিবসের র‌্যালিতে অংশগ্রহণ করবে। শহিদ দিবসে শহিদ মিনারে ফুল দিবে, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গান শুনবে— তাহলেই তার মনে সংস্কৃতির স্থায়ী বিকাশ ঘটবে যা সম্পূর্ণ আমাদের নিজস্ব, স্বতন্ত্র এবং মৌলিক। শৈশবে যদি সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ পাওয়া যায় তবে তা অবশ্যই মেধা বিকাশে কাজে লাগবে।সংস্কৃতি মানুষকে সুন্দরের পথ দেখায়, আর অপসংস্কৃতি মানুষকে অসুন্দরের পথে নিয়ে যায়। অপসংস্কৃতি দিয়ে মনের চাহিদা মিটালে আমরা পিছিয়ে পড়ব এবং নিজস্ব সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য থেকে দূরে সরে যাব। আমাদের তরুণরা অপসংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে তার কারণ এতে চমক আছে। উত্তেজনা আছে, আর আছে ক্ষণিক আনন্দ। তরুণরা চঞ্চল। তারা চায় নতুন কিছু করতে, নতুনের সাথে চলতে। আর এই নতুন কিছু করতে গিয়ে তারা আমাদের ঐশ্বর্য ভুলে ভিন দেশি কুরুচিপূর্ণ সংস্কৃতি ধারণ করে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। একটি দেশের ভবিষ্যৎ হলো সেই দেশের তরুণ সমাজ। তাদের উপর অপসংস্কৃতির কুপ্রভাব অতি গভীর এবং ব্যাপক। তাদের অনেকে সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি অনুশীলনে মেতেছে। সিনেমার কাহিনি, নাচ, গান, পোশাক ইত্যাদি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উদ্ভট ভাবে সন্নিবেশিত হয়ে থাকে যা বাস্তব জীবনকে বিকৃত করে। সুস্থ সংস্কৃতি মানুষের প্রয়োজন পরিপূরণে অত্যন্ত কল্যাণময়। সংস্কৃতি মানুষের জীবনে একটি শৈল্পিক প্রকাশ। সত্য ও বাস্তবতা যা মানব প্রকৃতির অন্তর্গত চাহিদার পরিতৃপ্তি ও চরিতার্থতারই ফসল। হৃদয়ানুভূতি, চিত্তবৃত্তি, আবেগ -উচ্ছ্বাস ও মানসিক ঝোঁক -প্রবণতার সাথে সংস্কৃতির নিবিড় সম্পর্ক। একটি দেশের সংস্কৃতির রস অন্য দেশের থেকে ভিন্ন। সংস্কৃতির উদ্দেশ্য যদি মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য হয় তবে তা সুস্থ সংস্কৃতি হিসেবে গণ্য হতে বাধ্য। সুন্দরের চর্চা বা অনুশীলনের মাধ্যমে সংস্কৃতির গতিশীলতা আসে, পরিশীলিত হয় মানুষের জীবন-যাপন। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে পুরাতন ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হলো পরিবার।পরিবারে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা না হলে বিশুদ্ধ মনের মানুষ গড়ে উঠা কঠিন। সংস্কৃতিবান মানুষ মানেই ভদ্র-সভ্য -বিনয়ী মানুষ। সুরুচিশীল ও পরিচ্ছন্ন মানুষ, সুন্দর মনের ও মার্জিত স্বভাব চরিত্রের মানুষ, নতুনকে মেনে নেওয়ার হৃদয় সম্পন্ন মানুষ, উদার চিন্তা-চেতনা -কল্পনা সম্পন্ন মানুষ, উৎকর্ষ আত্মার মানুষ। পরিবারে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার ফলে জাতিসত্তা ও স্বকীয়তা সম্পর্কে সচেতন থাকা যায়। দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করা যায়। শালীনতার ভিতরে থেকে সঙ্গীত, অভিনয়, নৃত্যকলা, চলচ্চিত্র, চিত্রকর্ম ও সাহিত্যচর্চা মানুষের কল্যাণে সহায়ক ভুমিকা পালন করে। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা মানুষকে সৃজনশীল করে তাদের আনন্দে মাতিয়ে রাখে। সুস্থ প্রজন্ম গঠনে সহায়তা করে। যে সুস্থ সংস্কৃতিবান নয়, সে যে পেশারই হোক না কেন তার কর্ম ও আচরণে জাতি আর্থ-সামাজিকভাবে উন্নত হয়না। ভবিষ্যত প্রজন্মকে সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়তে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার বিকল্প নেই। সুস্থ সংস্কৃতিই পারে কুসংস্কারমুক্ত একটি প্রগতিশীল, আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক জাতির নিশ্চয়তা দিতে। সুস্থ সংস্কৃতির নান্দনিক বিকাশের মাধ্যমেই ঐতিহ্যের লালিত সেতু বন্ধনে অনায়াসে পৌঁছতে পারে মানুষ। নৈতিকতা সমৃদ্ধ সমাজ গঠতে এবং মানবিকবোধের জাগরণ ঘটাতে সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। মানবিকবোধ দ্বারাই অশুভকে নাশ করে শুভ শক্তির উদ্ভব ঘটানো যায়। সংস্কৃতি চর্চার আলোয় সাদা হোক সকল কাল। মুক্ত সংস্কৃতির দূষণে যেন দূষিত না হয় আমাদের স্বদেশি সংস্কৃতি। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চাই হোক আগামী প্রজন্মের অহংকার। তরুণদের মধ্যে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা বজায় রাখার জন্য পাড়া-মহল্লায় পাঠাগার স্থাপন করে সেখানে দেশ বিদেশের ভালোমানের বই, ম্যাগাজিন সংগ্রহ করতে হবে। জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে হবে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা, উৎসব বা সত্য-সুন্দরের চর্চা করতে গিয়ে কোনো অপসংস্কৃতি যেন মানুষের মাঝে ঢুকে না যায় সে বিষয়ে সকলের সজাগ থাকা জরুরি। সংস্কৃতি দীর্ঘ দিনের লালিত ফসল—-সেখান থেকে বিচ্যুত হয়ে অপসংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশ করা কোনো দেশ বা জাতির কাম্য নয়। লেখক : প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক।