বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘শিশুদের জন্য পৃথিবীতে যা কিছু লেখা হয় তার উদ্দেশ্য শিক্ষা নয়তো বিবিধ লোভনীয় সামগ্রী সাজিয়ে খেলনার প্রতিদ্বন্ধী হওয়া তার চেষ্টা। কিন্তু কখনো কখনো এমন হয় যে লেখা, শিক্ষার কি আমাদের যাত্রা করেই, পৌঁছোয় তার পরপারে উত্তীর্ণ হয় রসলোকে, আর তা যখন হয়, তখনই সে লেখা বয়স্কভোগ্য হয়ে ওঠে, তার মধ্যে ধরা পড়ে দুটো স্তর, একটা তৃপ্ত করে বালক বালিকার চোখ, কান, কৌতুল ও কল্পনার উৎসুক তাকে, আর-একটাতে পূর্ণ বিকশিত বুদ্ধির আনন্দ।’ শিশুসাহিত্যিক রমজান আলী মামুনের ছড়া-কবিতাও উভয় শ্রেণীর পাঠকের কাছে শুধু গ্রহণীয়ই নয়। তাদের উৎসুকতার দাবিও মেটাতে সক্ষম। তাঁর ছড়া বা কিশোরকবিতা গুলো যেমন স্বচ্ছন্দ, তেমনি সাবলীল।
রমজান আলী মামুন (১৯৬৭-২০১৯) বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যাঙ্গনে এক পরিচিত নাম। তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি নিরচ্ছিন্নভাবে লিখেছেন ছড়া, কবিতা ও গল্প। ১৯৯১ সালে বেরিয়েছে তাঁর প্রথম কিশোর গল্পগ্রন্থ ‘হারিয়ে যাওয়া দুপুরে’। এরপর ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছে আকাশ পরী ও পাপিয়া, এক যে ছিলো রাজকন্যে, দিবা ও রহস্যময় বুড়ো, কিশোর নেমেছে যুদ্ধে, কিশোর উপন্যাস ‘রেল ছোটে মন ছোটে’, কিশোর কবিতাগ্রন্থ ‘নীল ডানা এক পাখি’ ‘সবুজাভ কোন গ্রামে’; ছড়াগ্রন্থ ‘ছড়ার গাড়ি থামবে বাড়ি’। কিশোর কাব্যগ্রন্থ ‘নীল ডানা এক পাখি’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৯ সালে। গদ্য ও পদ্য-উভয় অঙ্গনে রমজান আলী মামুন স্বতৎস্ফূর্ত ও নিবেদিতপ্রাণ।
প্রকৃতি প্রেম একজন কবির জন্য অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে অনুভব না করেন এমন কোনো কবি নেই। এজন্যে কবিতার শরীর চিরকালই চিত্রসমৃদ্ধ। সেই আদিকাল থেকে যে সব কবিতা ছোটোদের জন্য রচিত হয়ে আসছে, এবং যে সব কবিতা যুগ অতিক্রম করে বংশ পরম্পরায় আমাদের মনকে আলোড়িত করে যাচ্ছে; তাদের প্রায় সবক’টিই নৈসর্গিক চিত্রসমৃদ্ধ ব্যঞ্জনাময় কবিতা।
ছোটোদের কবিতা তথা কিশোরকবিতা চর্চার সেই ধারাবাহিকতায় পাঠকের কাছে নিজের প্রতিভা নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন রমজান আলী মামুন। তিনিও তাঁর পূর্বসূরীদের মতো পাঠকের অনুভূতিকে রঞ্জিত করার জন্য নিঃসঙ্কোচে ছুটে গেছেন প্রকৃতির পাঠশালাতে। ফুল-পাখি-নদী-আকাশ ইত্যাদি নৈসর্গিক উপাদানই হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতার শ্রেষ্ঠ অনুষঙ্গ। বেশিরভাগ কবিতার অধিকাংশই প্রকৃতিঘনিষ্ট ছবিময় কবিতা, যেগুলো পাঠককে নিয়ে যাবে তার হারানো শৈশবে এবং ক্রমশ হয়ে পড়বে স্মৃতিকাতর। এখানে কয়েকটি পংক্তি উল্লেখ করছি :
ভোরের পাপিয়া ডাকে বিভোর হয়ে
মেঘের পাহাড় একা থমকে থাকে
সোনালি সূর্য হাসে পৃথিবী ছুঁয়ে
কে যেনো জানলা দিয়ে আমাকে ডাকে।
( স্নেহের শেকলে)
মেঘ থমথম মেঘলা আকাশ
কুমার নদীর বাঁকে
হারিয়ে যাওয়া সেদিনগুলো
এই আমাকে ডাকে
………………………………………..
বাদলা দিনে মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি নিয়ে এলে
কলার ভেলায় ছলকে যেতাম
ঘরের দাওয়া ফেলে
( হারিয়ে যাওয়া দিন)
শিশির ঝরে রূপোর দানার মতো
কলার পাতায় দেয় এঁকে দেয় চুম
কী দেখি ছাই বাইরে উদাস হয়ে
দু’চোখ জুড়ে আর আসে না ঘুম
(দুপুর রাতে)
আমার ছেলেটা পায় না সবুজ মাঠ
হাঁফিয়ে ওঠে ইট পাথরের ঘরে
লকলকে করে বেড়ে ওঠা শুধু সার
কঠিন শহরে মনটা গুমরে মরে।
আমার মেয়েটা ছুটে যায় ইশকুলে
প্রতিটি মিনিট উদ্বেগে করি পার
যানবাহনের ছোটাছুটি দেখে দেখে
অজানা ভয়ে কেঁপে উঠি বার বার।
শহরের ভিড়ে ব্যস্ততা শুধু বাড়ে
সারাদিন শুনি দানবের হাহাকার
বিষের ধোঁয়া বাতাসের সাথে মিশে
সবুজ নগরী করে দেয় ছারখার।
যে শহর শুধু তাজা প্রাণ কেড়ে নেয়
সে শহরে বাস আর নয় আর নয়
চলো ছুটে যাই সবুজাভ কোনো গ্রামে
যেখানে জীবন স্বর্ণালি মধুময়।
(সবুুজাভ কোনো গ্রামে)
আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যায়। এক কথায় তাঁর ‘নীল ডানা এক পাখি’ ও ‘সবুুজাভ কোনো গ্রামে’ গ্রন্থদুটিকে বলা যেতে পারে প্রকৃতিঘনিষ্ট চমৎকার কাব্যগ্রন্থ।
একজন কিশোর কখনো ঘরের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকতে চায় না। সে থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগৎটাকে বলে বেরিয়ে পড়তে চায়। নজরুলের কিশোরের মতো মামুনের কিশোরও ঘরের ভেতর আটকে থাকতে চায় না, ঘর ছাড়া হতে চায়। তার কয়েকটি কবিতায় এ প্রসঙ্গটি রূপায়িত হয়েছে স্পষ্টভাবে। যেমন :
‘রাতের বেলায় দূর আকাশে যখন ফোটে তারা
আমার তখন ইচ্ছে করে হতে যে ঘরছাড়া।’
( ডাক)
স্নেহের শেকলে বেঁধে অমন করে
নিষেধের বেড়াজালে মা তুমি কেনো
আমাকে আটকে রাখো একলা ঘরে
স্বাধীনতাহীন আমি মানুষ যেনো ।
( স্নেহের শেকলে)
তবে রমজান আলী মামুনের কবিতার কিশোরটি দুরন্ত নয়, লাজুক; ডানপিটে নয়, ভাবুক। তাই তাঁকে আকাশ হাতছানি দেয়, কর্ণফুলী ও লুসাই পাহাড় তাঁর মন কেড়ে নেয়। তরুলতা-শাপলা ফোটা ঝিল- জোছনা রাতের তারা-নীল পায়রার রাত তাঁকে আনমনা করে। তাই কিশোরটি বলতে পারে-
‘সূর্য যেনো ঝলসানো এক বাটি
দেয় ছড়িয়ে তপ্ত আলোর কণা
লালদীঘিটা হয় কী শীতলপাটি
ভাবলে এসব হই আমি আনমনা’
( হই শুধু আনমনা)
রমজান আলী মামুনের কবিতায় দেশপ্রেমের কথা আছে, মুক্তিযুদ্ধের কথা আছে, মায়ের দোয়ার কথা আছে, বোনের ¯েœহের কথা আছে, আছে সৃষ্টিকর্তার দয়ার কথা। আছে খেটে খাওয়া মানুষের কষ্টের বর্ণনা এবং সর্বোপরি আছে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের মধুর দিনগুলোর কথা। তিনি প্রায় সবক’টি কবিতায় তাঁর কাব্যশক্তির স্ফুরণ ঘটাতে চেষ্টা করেছেন। শব্দ-চয়নে, উপমা প্রয়োগে, চিত্রকল্পে তাঁর দু’য়েকটি কবিতা গতানুগতিক হলেও অধিকাংশ কবিতাই হয়ে উঠেছে হৃদয়গ্রাহী। অকপটে মনকে নাড়া দেয়ার অদৃশ্য শক্তি যেনো তাঁর কবিতার শরীরে বিদ্যমান।
মা বিষয়ে লিখেননি এমন কোনো লেখককে পাওয়া যাবে না। রমজান আলী মামুনও লিখেছেন তাঁর দরদি মন নিয়ে। জানিয়েছেন ভালোবাসা। প্রকাশ পেয়েছে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা। তাঁর হারিয়ে যাওয়া মাকে লেখা কবিতাটি এখানে তুলে ধরতে চাই।
যাই না মাঠে যাই না ঘাটে
দিনগুলি হায় কষ্টে কাটে।
ক’ টার সময় ফিরছি বাড়ি
এসব নিয়ে চিন্তা ভারি,
করবে কে আজ শুনি
দিনগুনি-দিন গুনি।
কথন অফিস, আবির হয়ে
দিনতো যেতো কষ্ট সয়ে
কিংবা আমার কবিতারা-
আমায় দিতো একটু নাড়া,
বলতো কবি- ঘরমে চলো
মাকে দেখার সময় হলো !
হুঁশ হলে ফের দৌড়ে এসে
একলা টানি ঘানি
মা বিছানায় এপাশ ওপাশ
করতো শুধু জানি।
এমনি গেছে দিন
মা ও ছেলের মনবেদনায়
বুক করে চিন চিন।
আজকে আমি একা
ও-দরদী দুঃখিনী মা
দাও না কেনো দেখা?
(ও-দরদী মা)
রমজান আলী মামুন নানা বিষয়ে কিশোরকবিতা লিখেছেন। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে তাঁর একটি লেখা এখানে উল্লেখ না করে পারি না।
খেলার মাঠে যেতে মানাÑনদীর কাছেও না
কোথায় আমার স্বাধীনতার অবাধ ঠিকানা।
আকাশ যখন উঠবে ফুটে তারার বাগান হয়ে
জানলা গলে দেখতে থাকি কষ্ট সয়ে সয়ে।
সাত সকালে ফুলের বনে শিউলি যখন ঝরে
কুড়িয়ে নিতে কোচড় ভরে মনটা কেমন করে।
পারি না তো দাপিয়ে যেতে সবার আগে আগে
ইচ্ছেগুলো নেতিয়ে পড়ে স্বপ্ন কুসুম বাগে।
ঠিক দুপুরে গাছের ডালে আসর বসায় পাখি
রোদের ঝিলিক জড়িয়ে গায়ে করছে মাখামাখি।
সেই সেখানে যেতে আমার মন যে ভারি চায়
প্রতিবন্ধী বলেই কি আজ হচ্ছি নিরুপায়।
কবিতায় প্রতিবন্ধীদের প্রতি ভালোবাসা জাগানোর প্রয়াস লক্ষণীয়। এরকম আনকোড়া অনেক বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন, যা সত্যিই প্রশংসনীয়।
রমজান আলী মামুনের কবিতার স্বর স্পষ্ট, সুর গতিময়। ফলে তাঁর কবিতা স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বচ্ছন্দ। ছন্দকে ইচ্ছেমতো বেকিয়ে-চুরিয়ে, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তিনি জটিলতার দিকে নিয়ে যেতে চাননি। তাই তাঁর পংক্তি ভাঙা ভাঙা নয়, অসমান নয়; রেললাইনের মতো সমান্তরাল ও পরিচ্ছন্ন। তাঁর কবিতার বিষয় বৈচিত্র্যের মতো তাঁর ছন্দও প্রচ্ছন্ন। মামুনের কান যে অত্যন্ত সজাগ, তার প্রমাণ মেলে তাঁর কবিতাগুলোতে। মাত্রাবৃত্ত ছন্দ এবং স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত তাঁর কবিতা।
রমজান আলী মামুন যেমন প্রতিভাবান, তেমনি নিষ্ঠাবান ও পরিশ্রমী। কিশোরদের জন্য রচিত তাঁর গল্প-উপন্যাস যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি ছড়া ও কিশোরকবিতাগুলিও অনন্যসাধারণ। গদ্য ও পদ্য- উভয় অঙ্গনে তিনি সমানভাবে আমাদের প্রাণিত করেছেন তাঁর শক্তি দিয়ে।
আজ ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষ্যে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই শ্রদ্ধা। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই, অতি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে সাঈদুল আরেফীন সম্পাদিত ‘রমজান আলী মামুন স্মারকগ্রন্থ’। এটি শ্রমলব্ধ একটি সংকলন। প্রকাশ করেছে প্রজ্ঞালোক। গ্রন্থটির জন্য অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক এমরান চৌধুরী। তাঁদের জানাই কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।