“বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলে বেলার গান…বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এলো বান। যদি ডেকে বলি, এসো হাত ধরো চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে এসো গান করি, মেঘ মল্লারে করুনাধারা দৃষ্টিতে আসবে না তুমি, জানি আমি জানি, অকারণে তবু কেন কাছে ডাকি। কেন মরে তৃষ্ণাতে, এই এসো না চলো জলে ভিজি শ্রাবণ রাতের বৃষ্টিতে”।
গাড়ির সাউন্ড সিস্টেম থেকে ভেসে আসছিল হাবিব ওয়াহিদের গাওয়া অসাধারণ গানটি। বাদলা দিনে আমরা গিয়েছিলাম গাজীপুরের শ্রীপুর এলাকায় অফিসিয়াল ট্যুর এ। সারাদিন গাদা গাদা কাজ করতে কিছুটা একগুয়েমি অনুভব করছিলাম। অতঃপর ডাক বাংলোতে বসে ভাবছিলাম অবকাশ যাপনে যাওয়া দরকার। বর্ণ ও তাঁর মাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের নুহাশ পল্লীতে। গাড়ি ছুটে চলেছে, আকাঁ বাঁকা রাস্তা বেয়ে। আকাশে মেঘ রাশি গুলো কেমন জানি দলবদ্ধ হয়ে ঝুলে আছে। জলীয় বাষ্পগুলো উড়ছে মেঘের বেলায় চড়ে। একটু পড়ে মনে হয় আকাশের পেট ছিড়ে নামবে বৃষ্টি। গুড়–ম গুড়–ম বজ্রপাতের শব্দ। আকাশ ঝাঁকিয়ে বৃষ্টি নামল। গাড়ির স্বচ্ছ কাচের উপর বৃষ্টির ফোটা গুলো আচড়ে পড়ছে টুপ টাপ করে। বর্ণ-ও তাঁর মা আফরোজা পাগলামী শুরু করল,চলো বৃষ্টিতে ভিজি। বর্ণ গাড়ির কাচ বৃষ্টি ফোটাগুলো স্পর্শ করার চেষ্টা করছে। আফরোজাকে বললাম নুহাশ পল্লীতে গিয়ে বৃষ্টি বিলাসে ভিজতে পারবে !
গাজীপুরের কাছে হুতা পাড়া বাজার হয়ে যে সড়কটি উত্তর পাশে চলে গেছে ঠিক তাঁর মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছে। মাঝে মাঝে মেঠো পথে কাদা মিশ্রিত পানিতে গাড়ি চাকা আটকে যাচ্ছিল বার বার। রাস্তার পাশে শাল বন, গজার, সেগুন আরো নানা প্রকৃতি গাছ গাছালিতে ছেয়ে আছে। একেবারে পাখি ডাকা ছায়া ঘেরা এক বন। গাড়ি এসে থামল পিরুজালী গ্রামের নুহাশ পল্লীর মুল ফটকের সামনে। হুতা পাড়া বাজার থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার পথ পেরুলে নুহাশ পল্লী। বৃষ্টির ছাঁট কিছুটা কমে এসেছে। বৃষ্টির ছোঁয়া নিয়ে নুহাশ পল্লীতে প্রবেশ করলাম। নুহাশ পল্লীতে প্রবেশ করতে হলে ২০০ টাকা দিয়ে টিকেট সংগ্রহ করতে হয়। নুহাশ পল্লীর অর্জিত আয় দিয়ে পল্লীর রক্ষাণাবেক্ষণ খরচ এবং লেখক হুমায়ুন আহমেদর প্রতিষ্টিত করা নেত্রকোনার কুতুবপুর গ্রামের শহীদ বিদ্যাপিঠের যাবতীয় খরচ মেঠানো হয়। নুহাশ পল্লীতে প্রবেশ করতে যে কারও মন জুড়িয়ে যাবে। প্রকৃতির বিচিয়ে দেয়া সবুজ গালিচা বিছানো পুরো মাঠ জুড়ে দুর্বা ঘাসের চাদর। আফরোজা হাত দিয়ে বৃষ্টিভেজা ঘাসগুলো স্পর্শ করে তাঁর মুখে লাগাতে লাগল। বর্ণ চিৎকার করে বলছে বাবা ওয়াহ কি সুন্দর নুহাশ পল্লী। বাবা দেখেঅ ভুত ভুত।
লেখক হুমায়ুন আহমেদ ১৯৯৭ সালে ৪০ বিঘা জমির উপর এটি গড়ে তুলেন। নুহাশ পল্লীতে লেখক তিন তিনটি বাংলো ঘর স্থাপন করেছেন। সত্যি দেখার মতো। একজন লেখকের যে এতো চমৎকার রুচি সত্যি অবিশ্বাস্য। নুহাশ পল্লীতে না আসলে বুঝাই যাবে না যে গাজীপুরের হুতা পাড়ার পিরুজালী গ্রামের ছবির মতো ছায়া ঘেরা সুন্দর এক পল্লী। লেখক তাঁর সন্তানের নামে নাম রেখেছেন নুহাশ পল্লী। ছোট পাকা বাংলোটির পাশে আপেল গাছ। তাঁর একটু সামনে কাঠের নকশা করা বৃষ্টি বিলাস বাংলো। বাংলোর ভিতর শুটিং-র সরঞ্জাম আরও কত কি। কিছুটা দুরে ভুত বিলাস বাংলো। ছোট একটি সুইমিং পুল নির্মাণ করেছেন। লেখক মাঝে মাঝে সুইমিং পুলে নেমে গলা পরিমান পানিতে বসে থাকত কখনও, কফি চা পান করত। আড্ডা দিত প্রিয়জনদের সাথে। পাথরের ফলকে খুদাই করা লিখা আছে,“রাশেদ হুমায়ুন ঔষদি উদ্যান আমার ছোট বাবাকে মনে করছি”। একটু দুরে বড় এক দৈত্য দানবের মুর্তি হাত বের করে দিয়ে হা করে বসে আছে। তাঁর অপর পাশে পদ্মপুকুরে জীবন্ত এক মৎস্য কন্যার মুর্তি দেখলে মনে হবে যেন দিঘীতে হেটে হেটে পদ্ম ফুল তুলতে ব্যস্ত আছেন। পাশে দাবার গুটির প্রতিকৃতি, টি হাউস, নানাধরনের দৃষ্টি নন্দন স্থাপত্য। পল্লীর একপাশে চোখে পড়বে শুভ্র বর্ণের হুমায়ুন আহমেদের আবক্ষ মুর্তি, লেখক হুমায়ুন আহমেদ কে কোন এক জন্মদিনে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে উপহার দেয়া হয়েছিল। এছাড়াও নয়নাভিরাম লেখক হুমায়ুন আহমেদের নুহাশ পল্লীতে হরেক রকমের নাম না জানা বৃক্ষ রয়েছে সত্যি তিি যে এক আজব বৃক্ষপ্রেমি তা নুহাশ পল্লীতে এসে টের পেলাম।
প্রায় ২৫০ প্রজাতির দুর্লভ ঔষদি গাছ, ফলজ, বনজ,ভেষজ আরও কত বাহারি বিদেশী ফুলের গাছ রয়েছে। লেখক বিদেশে থেকে এনে নিজ হাতে চারা গাছগুলো লাগিয়েছেন। গাছগুলোকে যত্ন করতেন শিশুর মতো। বাংলোর পিছনে বিদেশী খেজুরের গাছ ও চোখে পড়েব। একটু সামনে গেলে ছোট একটা চা বাগান। মাঠের চারিদিকে হরেক রকমের বনজ ও ফলজ গাছ । মাঠের এক পাশে জীবন্ত মুর্তির মতো দাড়িয়ে আছে একটি দেবী তাঁর নীচে ছোট একটি শিশু । তাঁর এক পাশে কুমারী দেবী,,হাতে ফলের কাঁচা। অন্য পাশে বসার দুলনা। ছোট ছোট কিছু মাঠির কুটিরও চোখে পড়বে। একটু সামনে গেলে দেখা মিলবে আম গাছের উপর ছোট একটি টিনের কুড়ে ঘর। লেখক নিজে মাঝে মাঝে কুড়ে ঘরে বসে বই পড়তেন। না হয় চুপ চাপ বসে থাকত। মাঠের ঠিক পিছনে রয়েছে। লীলাবতি দিঘি। মাঠের মাঝখানে মার্বেল পাথর দিয়ে বাধানো আছে নামাজের স্থান। তাঁর অন্য পাশে ছোট একটা লিচু বাগান। লিচু বাগানের মাঝখানে চীর তরে শুয়ে আছে প্রিয় লেখক, প্রকৃতি প্রেমী বৃক্ষ প্রেমী,বৃষ্টি প্রেমী জোছনা প্রেমী, হুমায়ুন আহমেদ স্যার। দিঘী লীলাবতীর পাড়ে রয়েছে কাঠের সাঁকো। পঙ্কীরাজ নৌকা, পাথরে ক্ষুদাই করে লিখা,নয়ন তোমারে পাই না দেখিতে রয়েছে নয়নে নয়নে। লাইন দুটি পড়ে চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ল। আফরোজা কে বললাম দেখো, সত্যি আমি যেন জীবন্ত এক হুমায়ুন আহমেদ স্যারকে অনুভ করছি। মনে হচ্ছিল এইতো লেখক মুড়ায় বসে বসে আছেন, দোলনায় চড়ছেন, মাঝে মাঝে যেন মেঝেতে বসে কাঠের পিড়তে বসে বসে গল্প লিখছেন। নাটকের শুটিং করছেন নুহাশ পল্লীতে। দিঘিতে বড়শী নিয়ে চুপ চাপ বসে আছেন। মাঝে মাঝে আদা আর এলাচি মিশ্রিত ধুয়ইতি লাল চায়ের মগে চুমুক দিচ্ছেন ফুড়ত ফুড়ত করে।
জোছনা রাতে গানের আসর বসে আছেন। হুমায়ুন স্যারের দিক নির্দেশনায় গল ছেড়ে কে যেন গাইছে,ওগো দয়ার সাগর ওগো দয়াময়, চান্নিপসর রাইতে যেন আমার মরন হয়। গান শুনতে শুনতে জোছনার সোধা পান করছেন লেখক। মাঝে মাঝে যেন হলুদ পাঞ্জাবী পরিধান করে কদম ফুল হাতে নিয়ে বৃষ্টিতে ও ভিজছেন প্রিয়জনদের নিয়ে। একটু পড়ে টের পেলাম, আমি যেন প্রিয় লেখক হুমায়ুন বন্ধনায় মগ্ন হয়ে তন্দ্র বিলাস করছিলাম। তন্দ্রা কেটে গেলে টের পেলাম আমি আর আফরোজা বৃষ্টিতে ভিজছি দুজনের মাঝখানে নেচে নেচে ভিজছে আমার মেয়ে বর্ণ। বার বার কেন জানি ছুটে যাচ্ছিলাম, লিচু বাগানে যেখানে লেখক চীরতরে শুয়ে আছেন ঠিক সেখানে। এক সময় তিনজনে মিলে,হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করলাম। হে মহান সৃষ্টিকর্তা আপনি আমার প্রিয় লেখককে জান্নাতের বাগানের ফুল ফুটিয়ে রাখেন। যেদিন প্রিয় লেখক চির বিদায় নেন, সেদিনটির কথা বার বার মনে পড়ছিল, বৃষ্টিস্নাত এক পড়ন্ত দুপুরে লেখকের কফিন স্পর্শ করে চির বিদায় দিয়েছিলাম। ঠিক নয় বছর গত হলো প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ আমাদের মাঝে নেই। বিশ্বাস হয় না আমার। মনে হয় প্রতি বছরেই তিনি একুশের বই মেলায় আসেন হলুদ পাঞ্জাবী পরিধান করা হিমু সেজে। বইয়ের স্টলে বসে তাঁর বক্তদের অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। জোছনা রাতে নুহাশ পল্লীতে পায়চারি করে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন।
যখন সমাধি স্থল ত্যাগ করছিলাম ঠিক তখনই আবার বৃষ্টির ছোয়াঁ এসে স্পর্শ করে কানে কানে বলে গেল, মরিলে কাঁদিসনে আমার দায়,মরিলে কান্দিনস না আমার দায়! রে যাদু ধন মরিলে কান্দিনস না আমার দায়! সুরা ইয়াসীন পাঠ করিও বসিয়া কাছায়! যাইবার কালে বাঁচি যেন শয়তানের ধোঁকায় রে যাদু ধন মরিলে কান্দিনস না আমার দায়! প্রিয় লেখক আপনি শান্তিতে ঘুমান, মৃত্যুবার্ষিকিতে আপনাকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। কে বলেছে তুমি নেই। তুমি আছো মোর হৃদয়ে নীরবে নিভৃতে!