আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বাংলার সাহিত্য, গবেষণা, সংস্কৃতি ও সমাজ চিন্তার ক্ষেত্রে আধুনিককালে এক আদিপুরুষ, অতি কীর্তিমান এক বরণীয় ও স্মরণীয় মানুষ। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সর্বপ্রথম প্রাচীন ও মধ্যযুগের হারিয়ে যাওয়া বাংলা কাব্য সাহিত্য বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। তিনি প্রাণপাত পরিশ্রম না করলে প্রাচীন সাহিত্যের বহু খ্যাতনামা কবি ও তাদের কীর্তি হারিয়ে যেত চিরতরে। তৎকালীন রক্ষণশীল সামাজিক পরিবেশের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তার এক জীবনের শ্রম ও সাধনায় বিপুল সংখ্যক পুঁথি সংগ্রহ করেছেন, পাঠোদ্ধার সম্পন্ন করেছেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে আবদুল করিমের সাহিত্যবিশারদ অবদান শুধুমাত্র প্রাচীন পুঁথিপত্র সংরক্ষণের জন্যে নয়, তিনি বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিলেন। অন্ধকারকে হারিয়ে যে আলো জ্বালিয়েছেন তা কাল থেকে কালান্তরে বহমান থাকবে
উল্লেখ্য, সাহিত্যবিশারদের বাড়িতে মাঝে মাঝে বসতো পুঁথি পাঠের আসর। সেই আসরে নিয়মিত হাজির থাকতেন তারই আত্মীয় ও অনুসারী আবদুস সাত্তার চৌধুরী। সেই থেকে তাঁর পুঁথির প্রতি আগ্রহ জন্মে প্রবলভাবে। আবদুস সাত্তার চৌধুরীর বাড়ি ছিল পটিয়া থানার দক্ষিণ হুলাইন গ্রামে। প্রাথমিক জীবনে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতার।
১৯৬১-৬৬ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির প্রাচীন বাংলা পুঁথির পাণ্ডুলিপি ও লোকসাহিত্যের সংগ্রাহক পদে কর্মরত ছিলেন।
১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে পুঁথি সংগ্রাহক পদে যোগদান করেন। সম্ভবত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে যোগদানের পূর্বে ও পরে আবদুস সাত্তার চৌধুরী বিভিন্ন ভাষার বহু পা-ুলিপি, অনেক পুঁথি, দুষ্প্রাপ্য পুস্তক ও সাময়িকী সংগ্রহ করেছিলেন। এগুলো দিয়ে ১৯৭২ সালে গড়ে ওঠে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির ‘ পাণ্ডুলিপি ও দুষ্প্রাপ্য’ শাখা। এ শাখা সমৃদ্ধ করতে তিনি নিজেকে উজাড় করে দেন। ১৯৮২ সালের ৮ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে কর্মরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন তিনি। পুঁথি সংগ্রাহক আবদুস সাত্তারের একমাত্র পুত্র ছিলেন ইসহাক চৌধুরী। পুত্রকে অঢেল সম্পত্তি দিয়ে যেতে না পারলেও পুঁথিপাঠ, পুঁথিসংগ্রহ ও পাঠোদ্বারের কাজ কীভাবে করতে হয় তা শিখিয়েছিলেন নিপুণভাবে। পিতার মৃত্যুর পর ইসহাক চৌধুরী বিবলিওগ্রাফার পদে যোগদান করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে। চাকরির পাশাপাশি তিনি পুঁথি সংগ্রহ ও গবেষণার কাজে ব্রত ছিলেন। ইসহাক চৌধুরী নানা চড়াই-উৎরাই পার করে সংগ্রহ করেছিলেন বিভিন্ন ভাষার পুঁথি। তরুণ বয়সে পুঁথি সংগ্রহের নেশায় পেয়ে বসে তাঁকে। এ উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়ান চট্টগ্রাম জেলার আনাচে -কানাচে। ইসহাক চৌধুরী নিজে পুঁথি পাঠ করতে ও পাঠোদ্ধারে দক্ষ ছিলেন। তিনি বেশকিছু পুঁথির সংগ্রাহক, নতুন পাঠ ও ব্যাখ্যাদাতা ছিলেন। ইসহাক চৌধুরীর অনন্য কীর্তি ছিলো পিতা আবদুস সাত্তারের সংগৃহীত প্রাচীন পুঁথি-পাণ্ডুলিপির উপর ভিত্তি করে পটিয়া থানার হুলাইন গ্রামের নিজ বাড়িতে গড়ে তোলেন আবদুস সাত্তার চৌধুরী সংগ্রহশালা। এসব পুঁথি, পাণ্ডুলিপি , দলিলপত্র সমূহ আপন সন্তানের মতো আগলে রেখেছিলেন পরম মমতায়। দেখভাল থেকে শুরু করে প্রায়শই ঘাঁটাঘাঁটি করতেন তিনি। বলতে গেলে, সারাটা জীবন তিনি দক্ষিণ হুলাইনের গ্রামীণ পরিবেশেই কাটিয়েছেন এবং সেখান থেকেই দেশের বিদ্বৎমণ্ডলীতে সম্মানিত স্থান অধিকার করে নেন।
প্রসঙ্গত, ইসহাক চৌধুরী পুঁথি সাহিত্য, লোক সাহিত্য, চট্টগ্রামের বলিখেলা ও মনীষীদের নিয়ে প্রবন্ধ লিখতেন চট্টগ্রামের সবকটি পত্রিকায়।
ইসহাক চৌধুরী বহুতর পরিচয়ে একজন বিশিষ্ট বৌদ্ধিক পুরুষ। তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, পুঁথি সাহিত্যের বিশেষজ্ঞ ও বিবলিওগ্রাফার। পুঁথি গবেষণা ও লোকসাহিত্যের জন্য চট্টগ্রাম একাডেমি পদক, চট্টগ্রাম শিল্পকলা সম্মাননা, আবদুল হক চৌধুরী পদক, একুশে বইমেলা পরিষদ চট্টগ্রাম কর্তৃক সম্মাননা, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সম্মাননা, প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম পদক, পটিয়া মালঞ্চ পদকসহ আরো বিভিন্ন সংগঠন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে লোক সাহিত্য কর্ম ও গবেষণা কাজের জন্য স্বীকৃতি ও বিশেষ সম্মাননা পেয়েছেন।
গত বছর ২৩ নভেম্বর পুঁথি গবেষক ও প্রাবন্ধিক ইসহাক চৌধুরী সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন অদেখা ভুবনে। বহু গবেষণা তিনি আরদ্ধ, অসমাপ্ত ও অপ্রকাশিত রেখে গেছেন। তার যাপিত জীবন ছিলো একদম সাদাসিধা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, অমায়িক, কাজ পাগল, ও সদাহাস্যজ্বল।
বলা বাহুল্য, ইসহাক চৌধুরী ৩০ জুন ১৯৫২ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার দক্ষিণ হুলাইন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও তিন মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ বহুগুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
দীর্ঘ তিন দশক ধরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে ‘দুষ্প্রাপ্য’ শাখায় কর্মরত ছিলেন। সেকশন অফিসার পদ থেকে অবসরে যান। চাকরির শুরু থেকে অবসরে যাওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বিদ্যার আলো বিলিয়ে দিয়েছিলেন অগণিত জ্ঞান পিপাসুদের মাঝে। সেই আলোর বিচ্ছুরণে তৈরী হয়েছে বহু আলোকিত মানুষ।
গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন : সহকারী রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার।