বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর এবং ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণার পর যে সব তরুণরা উজ্জীবিত হয়ে দেশ স্বাধীনের জন্য রনাঙ্গণে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাদের মধ্যে ফরহাদ হোসেন অলক অন্যতম একজন। তখনকার টগবগে যুবক ফরহাদ হোসেন দক্ষিণ চট্টগ্রামে গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এর আগে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত থেকে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণও নিয়ে আসেন। উনার সমবয়সীদের কাছ থেকে শুনেছি তিনি মা-বাবা’কে না জানিয়ে দেশের টানে যুদ্ধের ময়দানে গিয়েছিলেন। উনার ভয় ছিল যদি মা-বাবা যেতে না দেন। তাই তাদের অগোচরে যুদ্ধে চলে যান। অত:পর জীবনবাজি রেখে বঙ্গবন্ধুর আহবানকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে তিনি এবং অন্য বীর’রা জাতিকে উপহার দিয়েছেন একটি স্বাধীন সার্বভৌমত্ব লাল সবুজের বাংলাদেশ। খেতাব পেয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে।
ছাত্র জীবনে ফরহাদ হোসেন অলক সরাসরি রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম কলেজে ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাকপটু এই ছাত্র নেতা। স্বাধীনতার পরবর্তীতে কোনো এক সময়ে কোনো এক অজানা অভিমানে তিনি রাজনীতি থেকে সরে পড়েন। বেছে নেন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ক্রীড়া সংগঠন কে। এখানেও তিনি মেধার স্বাক্ষর রাখেন। হয়ে উঠেন একজন দক্ষ সংগঠক। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়া সংগঠন চট্টগ্রাম আবাহনী ক্রীড়া চক্রের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। খেলাঘর সংগঠনের সাথেও জড়িত ছিলেন। চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদের প্রথম কাতারের সক্রিয় নেতৃত্বে ছিলেন জেদী স্বভাবের ফরহাদ ভাই।
আমার সাথে ফরহাদ ভাইয়ের পরিচয় গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। সে সময়ে চট্টগ্রামে সাড়া জাগানো একটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল পত্র লেখক লেখিকা গোষ্ঠী “পলগ”। ফরহাদ ভাই ছিলেন সেই সংগঠনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক সদস্য। উনার সহধর্মিণী বিশিষ্ট লেখিকা ও কবি ফরিদা ফরহাদ ছিলেন এই সংগঠনের সভাপতি। আমি উনার কমিটির একজন নির্বাচিত নাট্য সম্পাদক ছিলাম। পরবর্তীতে এই সংগঠনের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদকও হয়েছিলাম। ফরিদা ফরহাদের সুবাদে ফরহাদ হোসেন ছিলেন আমাদের সংগঠনের কমবেশি সবার দুলাভাই। তো দুলাভাই ছিলেন খুবই উদার মনের মানুষ। সবার সাথে খুব আন্তরিক ভাবে কথা বলতেন। আবার সংগঠনের ব্যাপারে গঠনমূলক সমালোচনা করতেও দ্বিধা করতেন না। এতে অবশ্য আমাদের চলার পথকে আরো সহজ করে দিত। তিনি শুধু অর্থ দিয়ে নয়; মেধা এবং মনন দিয়েও সংগঠনের জন্য কাজ করতেন, পরামর্শ দিতেন। উনার আগ্রাবাদ সিডিএস্থ বাসায় পলগের অনেক মিটিং করেছি। রমজানে ইফতার পার্টি করেছি। তিনি সবকিছুতে আন্তরিক ভাবে আমাদের সাথে থাকতেন। সর্বশেষ উনার বাসায় সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের সুহৃদ সমাবেশ হয়েছিল কবি ফরিদা ফরহাদের ৫৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে। সেদিনও দেখেছি ফরহাদ ভাই উদার চিত্তে সব কিছু করেছিলেন। উনার কথামালায় প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে এবং নানান সংগঠনে উনার অতীত কর্মকান্ডের কথা তুলে ধরেছিলেন। বিভিন্ন সংগঠন থেকে আগত অতিথিরাও সেদিন ফরিদা আপা এবং ফরহাদ ভাইয়ের সুখী দাম্পত্য জীবনের কথা এবং তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অজানা কথা প্রকাশ করেছিলেন। সেই দিন কবি ফরিদা ফরহাদ জন্মবার্ষিকী উদযাপন পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে যারা উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানটিকে আলোকিত করেছিলেন তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক রাষ্ট্রদূত জননেতা মরহুম আতাউর রহমান খান কায়সার, প্রয়াত সাহিত্যিক ফাহমিদা আমিন, প্রয়াত রাজনীতিবিদ বখতেয়ার নুর সিদ্দিকী, শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফি, অধ্যক্ষ ড. আনোয়ার আলম, বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক রাশেদ রউফ, ডা: দিলীপ দে, আবু তাহের মাসুদ, কবি আকতার হোসাইন, সংগীতশিল্পী মৃণালী চক্রবর্তী, নিজামুল ইসলাম শরফী, এস এম মোখলেসুর রহমান এবং রাজনৈতিক কর্মী মোরশেদ আলম অন্যতম।
একসময়ে ফরহাদ ভাই আমার এলাকায়ও কয়েক বছর ছিলেন। তখন দেখেছি উনার কঠিন সংগ্রামের জীবন। ঢাকা -চট্টগ্রামে দৌঁড়ের মধ্যে থাকতেন। সংসারে বেশি সময় দিতে পারতেন না। ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতেন। ব্যবসায় অনেক হোচট খেয়েছেন, প্রতারিত হয়েছেন আবার নিজ গুণে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন ঠিকই। ফলে হয়েছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। উনার ছেলে-মেয়েরাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। ফরহাদ ভাই ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। দৃঢ় মনোবলের মানুষ। উনার চিত্ত-বিত্ত দুটোই ছিল। উনি সামাজিক,সাংস্কৃতিক এবং ক্রীড়াঙ্গনে যেমন উদার চিত্তে কাজ করতেন ঠিক তেমনি গরীব, মেহনতি মানুষদেরও গোপনে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। তিনি শুধু ইহকাল নয়, পরকালের কথা চিন্তা করেও মসজিদ, মাদ্রাসা এবং এতিমখানায় বেশ সাহায্য সহযোগিতা করতেন। গারিঙ্গা বড় হুজুরের ভক্ত ছিলেন। পবিত্র হজ্ব পালন করেছিলেন সস্ত্রীক ২০০৪/৫ সালের দিকে। সুন্দর জীবনই চলছিল উনার। কিন্তু কোন সময়ে যে শরীরে রোগ শোক বাসা বেঁধেছে তিনি ভালোভাবে টেরও পাননি। কিডনি এবং ডায়াবেটিস সমস্যার সাথে বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ ও উনাকে আক্রমন করে বসে।
অবশেষে সফল এই মানুষটি আমাদের ছেড়ে উপর ওয়ালার ডাকে পরপারে চলে যান মাত্র ৬৮ বছর বয়সে। দিনটি ছিল ৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার রাতে। পরের দিন বাদ জুমা নগরীর জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ ময়দানে প্রথম নামাজে জানাজা শেষে উনাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। সবশেষে উনার ইচ্ছানুযায়ী উনার প্রিয় দ্বীনি প্রতিষ্ঠান চন্দনাইশ সাতবাড়িয়া রশিদাবাদ মাদ্রাসা ও এতিমখানা সংলগ্ন কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। বলে রাখি আমার জন্মস্থানও এই সাতবাড়িয়া গ্রামে। একসময়ে ফরহাদ ভাই আমার প্রতিবেশী ছিলেন। এখন উনার সর্বশেষ ঠিকানাও হলো আমার জন্মভূমির পাশে। সরাসরি আর দেখা হবেনা কখনো কিন্তু সমাধিটা কালে ভদ্রে হয়তো দেখা হবে। আর দেখা হলে দোয়া পাঠও হবে ইনশাআল্লাহ। ভালো থাকুন পরপারে ফরহাদ ভাই। ভালো থাকুন। আপনার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।