কবি নজরুল ইসলামের ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’ গানটি যার কণ্ঠে জনপ্রিয়তা অর্জন করে তিনি আব্বাস উদ্দীন আহমদ। যার নাম শুনলে আমাদের মনে পড়ে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে…’ কিম্বা ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে…’ আজ তার ১২০ তম জন্মবার্ষিকী। শৈলী টিভি অনলাইন পত্রিকার পক্ষ থেকে তার প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা।
১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর আব্বাস উদ্দীন আহমদ ভারতের কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জাফর আলী আহমেদ ছিলেন একজন আইনজীবী। আইনজীবী হিসেবে সন্তানকেও গড়ে তুলতে নিজের মতো করে। কিন্তু শৈশব থেকেই গানে গানে তানে তানে পথ চলতেন আব্বাস উদ্দিন আহমদ। প্রচণ্ড এক ভালোবাসা ছিল তাঁর গানের প্রতি। গানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। এসব দেখে পিতা জাফর আলী আহমদও তার মত পরিবর্তন করেন। সন্তানের গানের সুরে মুগ্ধ হন তিনি। আব্বাস উদ্দিন তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং পরে কুচবিহার কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। এরপর সংগীত চর্চাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। এক পর্যায়ে তার সাথে পরিচয় হয় কাজী নজরুল ইসলাম, ইন্দুবালা, জগত ঘটক, কাজী মোতাহার হোসেন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, আঙ্গুরবালা সহ অসংখ্য শিল্পীর সাথে। কাজী নজরুল ইসলামের অনুপ্রেরণায় বেশ কিছু গান (ঠুমরী, গজল) রচনা করেছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’’ গানটি আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে বহুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
আব্বাসউদ্দিনই প্রথম ভাওয়াইয়াকে রেকর্ড করে সকলের সামনে উপস্থাপন করেন। তার প্রথম রেকর্ডকৃত গান হল -‘ওকি গাড়িয়াল ভাই কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে…’ এবং ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে…’।
সেই যে শুরু, তারপর থেকে আর পেছনে ফেরা নয়। আব্বাস উদ্দিন ভাওয়াইয়াকে নিয়ে গেছেন অনেক দূর। দেশ থেকে দেশান্তরে। সেই সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভায় গান গেয়ে বাঙালিদের উদ্বুদ্ধ করতেন। গাইতেন ‘ওঠরে চাষী জগতবাসী, ধর কষে লাঙল’। শুধু ভাওয়াইয়া গানই নয় তিনি বাংলা ইসলামী গানেরও শ্রষ্ঠা । ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ এ বিখ্যাত গানটি লেখার জন্য কবি নজরুল ইসলামকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন তিনি। খুব ভয়ে ভয়ে তিনি এ গানটি রেকর্ড করেছিলেন। রেকর্ড কোম্পানিও গানটি রেকর্ড করতে ইতস্তত করেছিলেন। কারণ তখনকার সময়ে কোন মুসলিমের কণ্ঠে গান বাণিজ্যিকভাবে সফল ছিলো না। একই কারণে নজরুল ইসলামও আব্বাস উদ্দিন ছিলেন প্রথম সাহসী মুসলমান গায়ক যিনি আসল নাম ব্যবহার করে এইচ এম ভি থেকে গানের রেকর্ড বের করেছিলেন। এগানটি রেকর্ডেও পর যখন দেখলেন অল্পদিনেই এ গানটি হিন্দু মুসলিম সবার মুখে মুখে। এবং বাণিজ্যিকভাবে সফল তখন থেকেই তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন অনেক বাংলা ইসলামিক গজল। এ ছাড়াও তিনি উর্দু, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, দেহতত্ত্ব, মার্সিয়া, পালাগান ইত্যাদি গানও তিনি গেয়েছেন।
আব্বাস উদ্দিন কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, গোলাম মোস্তফা প্রমুখের ইসলামি ভাবধারায় রচিত গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন। রেকর্ডগুলো ছিল বাণিজ্যিক ভাবে ভীষণ সফল। তাই অন্যান্য হিন্দু ধর্মের গায়করা মুসলমান ছদ্মনাম ধারণ করে গান করতে থাকে।
শুধুই কি গান? আব্বাসউদ্দিন আহমেদ মোট ৪টি বাংলা চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন। সিনেমাগুলো হলো ‘বিষ্ণুমায়া ’ (১৯৩২), ‘মহানিশা’ (১৯৩৬), ‘একটি কথা’ এবং ‘ঠিকাদার’ (১৯৪০)।
আববাসউদ্দীনের গানের রেকর্ডগুলি এক অমর কীর্তি। আমার শিল্পী জীবনের কথা (১৯৬০) তাঁর রচিত একমাত্র গ্রন্থ। তিনি সঙ্গীতে অবদানের জন্য মরণোত্তর প্রাইড অব পারফরমেন্স (১৯৬০), শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৯) এবং স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে (১৯৮১) ভূষিত হন। ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। উল্লেখ্য যে, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র মোস্তফা জামান আববাসী এবং কন্যা ফেরদৌসী রহমান দেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী।