রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) মহৎ কবি, বাংলার কবিদের ভেতর তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ, বিশ্বসাহিত্যে গীতি কবিতার ক্ষেত্রে এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁর সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) তুলনার কোনো প্রশ্নই ওঠে না; তবে লক্ষ্য করবার ব্যাপার থাকে যে নজরুলও মহৎ এবং বাংলা কবিতার ইতিহাসে প্রতিভা ও অর্জনের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের পরেই তাঁর স্থান। প্রথম ও দ্বিতীয়র মধ্যে দূরত্ব অবশ্য দুর্লঙ্ঘ্য। কিন্তু তাঁরা একে অপর থেকে পৃথক, মহত্ত্বই তাঁদেরকে পৃথক করে দিয়েছে; রবীন্দ্রনাথের মানদ-ে নজরুলকে বিচার করাটা ন্যায্য নয়, যে ভুলটা অনেকে করেন, এবং দেখতে পান যে নজরুলের ভেতর সে-সব গুণ ছিল না যেগুলোর জন্য রবীন্দ্রনাথ অসামান্য। স্মরণে রাখা আবশ্যক যে নজরুলের সৃষ্টিশীল জীবন ছিল মাত্র ২২ বছরের, রবীন্দ্রনাথের সময়ের তিন ভাগের এক ভাগ।
কিন্তু এই দুই কবি অনেক বিষয়ে পরস্পরের কাছাকাছি ছিলেন; এবং সে-নৈকট্য কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। দু’জনেরই প্রধান পরিচয় যে তাঁরা কবি। নিজেদেরকে তাঁরা ওভাবেই দেখতেন, লোকেও তাঁদেরকে সেভাবেই দেখে। তাঁরা দু’জনেই আবার ছিলেন বহুমুখী; সাহিত্যের সব শাখাতেই তাঁদের কাজ আছে এবং তাঁরা দেশের রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, সমাজের অগ্রগতি ও মানুষের মুক্তি নিয়ে তাঁদের চিন্তা ছিল সার্বক্ষণিক। রবীন্দ্রনাথের মতোই নজরুলেরও ছিল সঙ্গীতের প্রতি গভীর আকর্ষণ এবং সঙ্গীতের ক্ষেত্রে দু’জনের অবদানই অসামান্য। হাজার হাজার গান তাঁরা রেখে গেছেন। গানে সুর দিয়েছেন, সুর সৃষ্টি করেছেন, সুরের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। নিজেরাও তাঁরা গান গাইতেন। বাংলা সাহিত্যে অন্য কোনো দু’জন কবি আমরা পাই নি যাঁরা সঙ্গীতে এতটা দক্ষ এবং এমন ভাবে সঙ্গীতমনস্ক ছিলেন। তাঁদের সব লেখাতেই, সে পদ্যই হোক কি হোক গদ্য, গান আছে। কবিতার সঙ্গে সংগীতের এমন মৈত্রী তাঁদের দু’জনের বাইরে অন্য কোনো বাঙালী কবির রচনাতে পাওয়া যাবে না। তাঁরা দু’জনেই জানতেন যে তাঁদের গান বাঙালীকে অনেক কাল গাইতে হবে, এবং সে ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয় নি। দু’জনেই নাটক লিখেছেন, নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন, অভিনয় করেছেন। তাঁরা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। তাঁদের ছিল কৌতুকের অসাধারণ বোধ, এবং তাঁরা শিশুদের জন্য যা লিখেছেন তাও অতুলনীয়। বক্তৃতা করেছেন সভা-সমাবেশে। সম্পাদনা করেছেন পত্রিকা। দু’টি ক্ষেত্রে অবশ্য নজরুলকে দেখা যায় নি; একটি হচ্ছে চিত্রাঙ্কন, অন্যটি বিদেশ-ভ্রমণ।
তিরিশের যে কবিরা প্রত্যেকেই নজরুলের চেয়ে নিজেদের উঁচু স্তরের মনে করতেন, তাঁরা কিন্তু শুধু লিখেছেনই, তার বাইরে যা করেছেন তাও ওই সাহিত্যের পাঠ ও পঠনের সঙ্গেই যুক্ত। তথাকথিত সাহিত্যিক ও অসাহিত্যিক কাজের ভেতর এই দুই কবি ব্যবধান জানতেন না। দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনায় দু’জনেই রোমান্টিক; স্পর্শকাতরতা তাঁদের সংবেদনশীলতা কোনো ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করে নি। তাঁরা আবেগের সঙ্গে লিখেছেন, সে জন্য যা-লিখেছেন তাই হয়েছে প্রাণবন্ত; কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁদের রচনাতে ছিল গভীর দার্শনিকতা, যদিও এক্ষেত্রে তাঁদের ভেতর বিস্তর পার্থক্য ছিল, যেটা সবারই জানা। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “আমি পৃথিবীর কবি যেথা যার যত ওঠে ধ্বনি/ আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি”। এবং যথার্থ কারণেই তাঁকে বিশ্বকবি বলা হয়েছে। নজরুলকে মনে হবে ভিন্ন রকমের, কারণ তিনি বলেছেন তিনি শুধু বর্তমানেরই কবি, ভবিষ্যতের নবী নন, যেন তিনি কেবল তাঁর দেশেরই; কিন্তু সেটা সত্য নয়, তাঁরও রয়েছে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি। তবে তাঁর আন্তর্জাতিকতা রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজনীনতা থেকে স্বতন্ত্র, কেননা তিনি নব-সৃষ্ট মেহনতী মানুষের আন্তর্জাতিকতায় আস্থাশীল হয়ে উঠেছিলেন। আদর্শবাদিতার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের মিল যদি হয় হেগেলের সঙ্গে তাহলে বলা চলে নজরুলের ঝোঁকটা মার্কসের দিকে। নজরুলের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ হওয়া যেমন অসম্ভব ছিল, পল্লীর কবি জসীমউদ্দীন হওয়াটা ছিল তেমনি চিন্তার বাইরে।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল উভয়েই গদ্য লিখেছেন প্রচুর; উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, প্রবন্ধ কোনো ধরনের রচনাতেই তাঁদের অনাকর্ষণ ছিল না। বক্তৃতা করেছেন সভা-সমাবেশে, প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, এবং অবশ্যই যুক্ত ছিলেন রাজনীতির সঙ্গে, যদিও সমমাত্রায় নয়। দু’জনেরই ব্যক্তিগত জীবনে দুঃসহ দুঃখ ছিল, কিন্তু সেই দুঃখ তাঁদেরকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে নি, উল্টো অন্যদের সঙ্গে সংলগ্ন করেছে; সকল মানুষের দুঃখকে তাঁরা মূর্ত করেছেন তাঁদের লেখায়। আবার তাদের দু’জনেরই রচনাতেই ছিল আনন্দের উজ্জ্বলতা; উচ্ছলতাও। তাঁদের ছিল স্বপ্ন, ব্যক্তিগত যতটা নয়, তার চেয়ে বেশী সমষ্টিগত। বাঙালীর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা অঙ্কের হিসাব দিয়ে দেখানো যাবে না।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে ১৯২০-এর দিকে নজরুলের যখন আগমন তখন রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন তাঁর গৌরবের পূর্ণতায়। তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁর প্রভাব সর্বত্রগামী এবং প্রায় সবদিকেই বিস্তৃত। তিনি গুরুদেব, তাঁকে অতিক্রম করা অসম্ভব। নজরুল নিজেও ছিলেন অত্যন্ত উৎসাহী ও গভীর ভাবে রবীন্দ্রভক্ত। নজরুলের রচনাতে বহু জায়গাতে রবীন্দ্রনাথের গান, উদ্ধৃতি, বাক্য, বাক্যাংশ পাওয়া যাবে। গীতাঞ্জলি’র গানগুলো ছিল তাঁর মুখস্থ, রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা বড় কবিতাও স্মৃতি থেকে উদ্ধার করতে পারতেন, অনায়াসে। রবীন্দ্রনাথের যত উপন্যাস পেয়েছেন তা পড়ার ভেতর দিয়েই নজরুল লেখক হবার প্রস্তুতি নেন। তাঁর বাঁধনহারা পত্রোপন্যাসের নায়ক যোগ দিয়েছে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে, বন্ধুমহলে সে কবি বলে পরিচিত। এক বন্ধু তাঁকে চিঠিতে লিখেছে সে যেন গুরুদেবের জন্য চ্যালেঞ্জ না হয়ে পড়ে, এবং তাঁকে নিশ্চিত করছে যে ওই সম্মান না পেলেও সে যে একজন অনুকারক কপি হবে তাতে সন্দেহ নেই। ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় নজরুল তাঁর নিজের কাজ বিষয়ে বলছেন যে লোকের অভিযোগ তাঁর লেখাতে চিরকালের সেই বাণী নেই যেটা গুরুদেবের রচনাতে পাওয়া যায়, এবং গুরুদেব নিজেও বলেছেন যে নজরুল তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা শুরু করেছে; নজরুল বলছেন যে হ্যাঁ, তিনি কবিগুরুর মতো হতে পারেন নি, কিন্তু তাতে তাঁর কোনো দুঃখ নেই কারণ ‘রবি’ তো রয়েছেন, আছে তাঁর ‘সোনার শত ছেলে’। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নজরুলের কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ কবিতাও আছে। সৃজনশীল জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে এসেও ‘কিশোর রবি’ নামের একটি কবিতাতে তিনি লিখেছেন যে তাঁরাই রবীন্দ্রনাথকে উপযুক্ত রূপে পাঠ করতে পারে যাদের ভেতর তারুণ্য রয়েছে, এবং তরুণদের জন্য রবীন্দ্রনাথ আশার উৎস। ‘ক্ষুধাতুর, উপবাসী চির-নিপীড়িত জনগণ’কে কবি ‘কৈবল্য ভীতির গুহা’ থেকে নিয়ে আসেন ‘আনন্দনন্দনে’। এই কবিতাটি যদিও তাঁর সৃষ্টিক্ষমতার যথার্থ সাক্ষী নয় কিন্তু দেখবার ভঙ্গিটা রয়ে গেছে আগের মতোই। তিনি যৌবনের কথা বলছেন, বলছেন ভীতির কথাও, এবং পীড়িত মানুষের প্রতি তাঁর সমবেদনার কথাও উল্লেখ করতে ভোলেন নি। ‘অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলি’ নামের আরেকটি কবিতা লিখেছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথের আশিতম জন্মদিনে, যাতে বলছেন, ‘একা তুমি জানিতে হে কবি, মহাঋষি, তোমারি বিচ্যুত-ছটা আমি ধূমকেতু।’ কবিতাটিতে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে কবিকে আরেকবার শ্রদ্ধা জানাবার সুযোগ হয়তো আর তিনি পাবেন না।
তাঁর সেই শঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। জীবিত কবিকে এরপরে শ্রদ্ধা জানাবার সুযোগ নজরুল আর পান নি। ১৯৪১-এ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু সংবাদে নজরুল শোকে বিহ্বল, বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। সেই অবস্থাতেই তিনি পরপর তিনটি কবিতা লেখেন, একটিতে বলেন যে ‘দুপুরের রবি ঢলে পড়েছে অস্তপারের কোলে’; অপরটির বক্তব্য ছিল কিছুটা ভিন্ন রকমের, ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত কবিরে জাগায়ো না জাগায়ো না/ সারাজীবন যে আলো দিল ডেকে তার ঘুম ভাঙায়ো না।’ শোকানুভূতির দ্বৈত-প্রকাশ। প্রথম কবিতাটি কলকাতার রেডিওতে আবৃত্তি করছিলেন, এবং আবৃত্তি করার সময়েই তাঁর দেহে রোগাক্রমণের লক্ষণ দেখা দেয়। আবৃত্তি তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেন নি, তাঁর জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
নজরুল যাঁদেরকে সোনার শত ছেলে বলেছেন সেই নবীন কবিরা সচেতন ভাবে চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্র-বলয় থেকে বের হয়ে যাবার; তাঁদের অনুভবটা ছিল এই রকমের যে বের হতে না পারলে মৌলিকতা দৃশ্যমান হবে না। তাঁদের ভেতর বিদ্রোহ ছিল; কিন্তু তাঁরা যথার্থ বিদ্রোহী ছিলেন না, কারণ তাঁদের লক্ষ্য ছিল কাব্যের মুক্তি, মতাদর্শের মুক্তি নয়, মতাদর্শের দিক থেকে তাঁরা রবীন্দ্র-বলয়ের ভেতরেই ছিলেন। ওই বলয় থেকে বের হয়ে যাবার জন্য নজরুলকে কিন্তু চেষ্টা করতে হয় নি। তিনি রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করে, সমৃদ্ধ হয়ে, অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন, এবং ভিন্ন এক পথ ধরে এগিয়ে চলেছেন। কপালকু-লার সেই বিখ্যাত প্রশ্ন, ‘পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ’ নজরুলের জন্য একটি প্রিয় সুবচন ছিল। অন্যদের মতো নজরুল অপ্রধান ছিলেন না, ছিলেন প্রধানদের একজন। কবিতার ক্ষেত্রে অপ্রধানের সঙ্গে প্রধানের পার্থক্য এখানে যে প্রধানরা কেবল সাহিত্যিক ভাবেই নয়, মতাদর্শিক ভাবেও ভিন্ন হয়ে থাকেন। সেই সঙ্গে প্রধান কবিরা নিজেদের পাঠকও তৈরী করে নেন। নজরুলের এই দুই ক্ষমতাই ছিল।