পূজা মানে পুনঃজাগরণ। মনের ভেতরে বারবার বা পুনরায় জাগিয়ে তোলাকেই ভগবানের পূজা বলে। পূজা শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সংবর্ধনা, সম্মান প্রদর্শন, শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, মহান দর্শন বা আদর্শ অনুসরণ। এক কথায় বলা যায় সেবক ও ঈশ্বরের ঐক্য স্থাপনই পূজা।
সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। দুর্গাপূজার ইতিহাস বেশ পুরান। অশুভ শক্তির প্রতীক মহীষাসুর দেবতাগণকে স্বর্গচ্যুত করলে হতভাগ্য দেবতাগণ মহীষাসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। তা থেকে পরিত্রাণার্থে ব্রম্মার শরণাপন্ন হন। ব্রম্মা শিব ও দেবতাগণকে নিয়ে বিষ্ণুর নিকট নিজেদের দুর্গতির কথা ব্যক্ত করে প্রতিকারের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান।
বিষ্ণুর পরামর্শ অনুযায়ী ব্রম্মা ,বিষ্ণু , শিবসহ সকল দেব-দেবী স্ব স্ব দেহ হতে তেজ নির্গত করে সকলের তেজ সমাহারে সৃষ্টি করলেন এক অপূর্ব মমতাময়ী নারীমূর্তি। মহিষাসুর বধের জন্য স্বর্গের দেবতারা নানা অস্ত্রে বিভুষিতা করলেন এই নবতেজসৃষ্ট নারীকে।
দেবীর দশহাতে দশটি অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন তারা। মহাদেব দেবীর হাতে ত্রিশূল তুলে দিয়েছিলেন। ত্রিশূলের তিন ফলা তিন মানব গুণ ব্যাখ্যা করে। স্বত্ত্ব, রজ ও তম । শঙ্খ দেবী দুর্গার হাতে তুলে দিয়েছিলেন বরুণ। শঙ্খকে সৃষ্টির প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়। সেজন্য দুর্গাকে পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা মনে করা হয়। সুদর্শন চক্র মহামায়ার হাতে তুলে দিয়েছিলেন বিষ্ণু। চক্র প্রদান করার অর্থ দেবীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে গোটা বিশ্ব। বজ্রাস্ত্র বা অশনি তুলে দিয়েছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র। এটি দৃঢ়তা ও সংহতির প্রতীক। ব্রম্মা তুলে দিয়েছিলেন পদ্ম। পদ্ম জ্ঞানকে প্রতিনিধিত্ব করে। এর অর্থ জ্ঞানের মাধ্যমে মুক্তি। যমরাজ প্রদান করেছিলেন গদা বা কালদ-। এটি মূলত ভক্তি, আনুগত্য ও ভালোবাসার প্রতীক। খড়গ বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার প্রতীক। যাদের দায়িত্বজ্ঞান এবং বোঝার ক্ষমতা রয়েছে তারাই এটি বহন করেন। অগ্নি, বিদ্যা ও জ্ঞানের প্রতীক। অগ্নিদেব এটি দেবীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তীর ও ধনুক দিয়েছিলেন পবনদেব। উভয়ই ইতিবাচক শক্তির প্রতীক। নাগরাজ দিয়েছিলেন সাপ। এটি চেতনা এবং শিবের পুরুষালী শক্তির প্রতীক। এছাড়াও দেবীর হাতে থাকে ঘণ্টা, অক্ষমালা, কমণ্ডুলু ও নানাবিধ অস্ত্রসমূহ। দুর্গার বাহন সিংহকে অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। সিংহ শক্তির প্রতীক।
সকল দেবতার শক্তির সম্মিলন এই মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গা। এর মধ্যেই রয়েছে দুর্গা পূজার তাৎপর্য। দুর্গতি থেকে রক্ষার জন্য দেবতাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি প্রমূর্ত রূপে প্রকাশ পায় দেবী দুর্গার প্রতীকে। ঐক্যবদ্ধ মিলিত শক্তির কাছে পরাভূত হয়েছিল অসুরেরা। বাধ্য হয়েছিল স্বররগরাজ্য ছেড়ে দিতে। মহিষাসুরকে বধ করার মধ্য দিয়ে বিজয় উৎসব পালিত হয় বলে দশমী বিজয়ের দিন। অন্যায়কে প্রতিহত করে ন্যায় প্রতিষ্ঠার দিন। দেবী দুর্গা কেবল কঠোর নন। তিনি মাতৃরূপে শান্তির দেবী হিসেবে ভক্তদের মনের মন্দিরে অধিষ্ঠিত আছেন। তাইতো যুগে যুগে বিভিন্ন নামে পূজিতা হয়ে আসছেন দেবী দুর্গা। কখনো তিনি কালী কখনো জগধার্থী আবার কখনো বা তিনি কাত্যায়নী। দুর্গতি থেকে রক্ষা করেন বলে মহাদেবীর আরেকনাম দুর্গতিনাশিনী। এ রকম বিভিন্ন নামে তিনি ভক্তদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত আছেন।
শ্রী শ্রী চণ্ডীতে উল্লেখ আছে সত্যযুগে রাজ্যহারা মহারাজ সুরথ ও আত্মীয়-স্বজন পরিত্যক্ত সমাধিবৈশ্য যথাক্রমে রাজ্যলাভ ও দুর্গতিমুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে মেধস মুনির আশ্রমে যান। সেখানে মুনির পরামর্শে মহামায়ার মহীময়ী মূর্তি নির্মাণ করে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন । পূজায় তুষ্ট দেবীর বরে তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হয়। মূলত তখন থেকেই বাংলাভাষি অঞ্চলে দুর্গামায়ের মৃন্ময়ী প্রতিমার পূজা শুরু হয়। এ পূজা বসন্তকালে হয় বলে এর নাম বাসন্তী পূজা।
কৃত্তিবাসী রামায়ন থেকে জানা যায় ত্রেতাযুগে অযোধ্যার রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রীরামচন্দ্র তাঁর প্রিয় সতিসাধ্বী স্ত্রী সীতাকে দশানন বীর বিক্রমশীল রাক্ষসরাজা রাবণের লংকাপুরী থেকে উদ্ধারের জন্য দেবী দুর্গার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। তখন ছিল শরৎকাল। দেবতাদের নিদ্রার সময়। নিদ্রিত সময়কালে কোনো দেবতাকে জাগ্রত করার নামই হল অকাল বোধন। ব্রম্মার স্তব-স্তুতীতে জাগ্রত হলেন দেবী মহামায়া। ব্রম্মা বললেন, রাবনবধে রামকে অনুগ্রহ করার জন্য তাঁকে অকালে জাগ্রত করা হয়েছে। প্রিয়তমা পত্নী সীতা উদ্ধারের জন্য শ্রীরামচন্দ্র অকালে এ পূজার আয়োজন করেছিলেন। যতদিন না রাবন বধ হয় ততদিন পূজা চলবে। শ্রীরামচন্দ্র ১০১টি নীলপদ্ম দিয়ে দেবীদুর্গার পূজা করে, অনুগ্রহ লাভ করেন এবং প্রিয়তমা পত্নীকে উদ্ধার করেন। সে সময় থেকে অকালে অর্থাৎ শরৎকালে শ্রী শ্রী দুর্গাপূজার প্রচলন। শরৎকালে হয় বলে একে বলা হয় শারদীয় দুর্গোৎসব।
সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী অবধি পাঁচদিন দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। আবার সমগ্র পক্ষটিকে দেবীপক্ষ নামে আখ্যায়িত করা হয়। দেবীপক্ষের সূচনা হয় মহালয়ার দিন থেকে। অন্যদিকে দেবীপক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিন অর্থাৎ পূর্ণিমায় ; এই দিনটি কোজাগরী পূর্ণিমা নামে পরিচিত ও বাৎসরিক লক্ষ্মীপূজার দিন হিসাবে গণ্য হয়। দুর্গাপূজা মূলত পাঁচদিনের অনুষ্ঠান হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা ও কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় তার সমাপ্তি।
দুর্গাপূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য কুমারী পূজা। পুরাণে কুমারী পূজার সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। শাস্ত্র অনুসারে সাধারণত ১ বছর থেকে ১৬ বছরের অজাতপুষ্প সুলক্ষণা কুমারীকে পূজার উল্লেখ রয়েছে। এদিন নির্বাচিত কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে দেবীর মত সাজানো হয়। হাতে দেওয়া হয় ফুল, কপালে সিঁদুরের তিলক এবং পায়ে আলতা। সঠিক সময়ে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে ষোড়শোপচারে পূজা করা হয়। চারদিক শঙ্খ, উলুধ্বনি আর মায়ের স্তব-স্তুতিতে পূজাঙ্গণ মুখরিত থাকে। কুমারী পূজার মাধ্যমে নারী জাতি হয়ে উঠবে পূত-পবিত্র, মাতৃভাবাপন্ন এবং শ্রদ্ধাশীল’।
১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ সর্বপ্রথম কলকাতার বেলুড় মঠে ৯ জন কুমারী পূজার মাধ্যমে এর পুনঃপ্রচলন করেন। হিন্দু সমাজে বাল্যবিবাহ, সতীদাহ, চিরবিধবাসহ নানা অবিচারে নারীরা ছিল নিপীড়িত। বিবেকানন্দ নারীকে দেবীর আসনে সম্মানিত করার জন্যেই হয়তো এই কুমারী পূজার প্রচলন করেন। ১৯০১ সালের পর প্রতিবছর দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে এ পূজা চলে আসছে। আধ্যাত্মিক ও জাগতিক কল্যাণ সাধনই কুমারী পূজার মূল লক্ষ্য। মাতৃ আরাধনা তখনই স্বার্থক হবে যখন ঘরে ঘরে দেবী দুর্গার মত মেয়েদের আত্মপ্রকাশ ঘটবে।
বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে দেবী দুর্গা পরম ভক্তিময়। তাঁর এক রূপ অসুরবিনাশী, আরেকরুপ মমতাময়ী মায়ের। অন্যায় আর অশুভ শক্তির বিপরীতে ন্যায় ও শুভশক্তির প্রতীক। আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। তাই এই দেশে অন্যান্য উৎসবের মত দুর্গাপূজাও একটি সার্বজনীন উৎসব। দেশের সব সম্প্রদায়ের মানুষ স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে দুর্গাপূজা হয়ে ওঠে জাতি ধর্ম বর্ণ সবার মিলন মেলা।
দুর্গোৎসবের এই মহৎ দিনে মায়ের কাছে আকুল প্রার্থনা আমরা যেন হিংসা, বিদ্বেষ ও সংকীর্ণতা ধুয়ে মুছে মনুষ্যত্বের মন্ত্রে দেশ ও জাতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারি।
সর্বমঙ্গল মঙ্গল্যে শীবে সর্বার্থ সাধিকে শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরি নারায়ণী নমস্তুতে।
অর্থ: হে দেবী সর্বমঙ্গলা, শিবা, সকল কার্য সাধিকা, শরণযোগ্য, গৌরি ত্রিনয়নী, নারায়নী তোমাকে নমস্কার।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, হাজী নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।