‘অ-য়ে অজগর আসছে তেড়ে/ আমটি আমি খাবো পেড়ে’- যোগীন্দ্রনাথ সরকার। যদিও শিশুমনস্তত্ববিদদের মতে কোমলমতি শিশুদের পড়ার শুরুতে অজগর তেড়ে আসার মতো ভয়ংকর একটি বিষয়ের অবতারণা করা ঠিক নয় তবুও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসগরের ‘বর্ণপরিচয়’ বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সহজ পাঠে’র বাইরে গিয়ে শিশুদের জন্য সৃষ্টি করেছেন সহজ ও সাবলীল ভাষার ‘হাসিখুশি’। এ বইটির মাধ্যমে শিশুসাহিত্যের গম্ভীর আকাশে তিনি সত্যি যেন চাঁদের হাসি ঢেলে দিতে পেরেছিলেন । যোগীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন স্নেহবৎসল শিশুসুলভ মানুষ, যিনি সারাজীবন শিশুসাহিত্যকে পরিপুষ্ট করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। আজ তাঁর ১৫৫ তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনে শৈলী টিভি অনলাইন পত্রিকার পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা।
১৮৬৬ সালে ২৮ অক্টোবর চব্বিশ পরগণার জয়নগরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি নিবাস যশোর। তাঁর পিতার নাম নন্দলাল দেব সরকার ও মাতা থাকমণি দেবী।
জয়নগরের পাঠশালায় শুরু হয় তার প্রাথমিক শিক্ষা। কিন্তু পরে ১৮৮৩ সালে সপরিবারে তাঁরা জয়নগর ত্যাগ করে কলকাতায় বসবাস শুরু করলে দেওঘর উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়েরর ভর্তি হন। সেখান থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যোগীন্দ্রনাথ কলকাতার সিটি কলেজে এফ.এ. পড়া আরম্ভ করেন। কিন্তু আর্থিক অনটনের জন্য পড়া অসম্পূর্ণ রেখেই সিটি কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা আরম্ভ করেন তিনি। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি শিশুসাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হন এবং শিশুসাহিত্য রচনা আরম্ভ করেন। আজগুবি ছড়া রচনায় তিনি খুব দক্ষ ছিলেন। তাঁর সংকলিত বই ‘হাসি ও খেলা’ ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয়। ‘জ্ঞানমুকুল’ নামক স্কুলপাঠ্য গ্রন্থটিও এ সময় প্রকাশিত হয়।
পাঠ্য বইয়ের বাইরেও ছোটদের জন্যে বই লেখা যেতে পারে, ছাপা যেতে পারে, একসময় তা ভাবাই হত না। সব ছিল নীরস পাঠ্যপুস্তক। এই ধারনার পবিবর্তন ঘটিয়ে তিনি প্রকাশ করলেন ’হাসি ও খেলা’। বইটি প্রকাশ সম্পর্কে কবি যোগীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ’আমাদের দেশে বালক বালিকাদের উপযোগী স্কুলপাঠ্য পুস্তকের নিতান্ত অভাব না থাকিলেও গৃহপাঠ্য ও পুরস্কার-প্রসাদযোগ্য সচিত্র পুস্তক একখানিও দেখা যায় না। এই অভাব কিঞ্চিৎ পরিমাণে দূর করিবার জন্যে হাসি ও খেলা প্রকাশিত হইল।’ আর তাই তিনি আজও শিশুসাহিত্যে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। সত্তরের বেশি বই লিখেছিলেন, সম্পাদনাও করেছিলেন। যোগীন্দ্রনাথের কালজয়ী বই ‘হাসিখুশি’।
তিনি ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজস্ব প্রকাশনালয় ‘সিটি বুক সোসাইটি’। সেই একই সালে প্রকাশিত হয় শিশুগদ্য পাঠের সচিত্র বই ‘রাঙাছবি’। ছোটোদের বইয়ের প্রকাশক হিসেবে তিনি অতুলনীয় ছিলেন।
সিটি বুক সোসাইটি থেকে যোগীন্দ্রনাথ নিজের বই ছাড়াও উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, দ্বিজেন্দ্রলাল বসু, নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, চ-ীচরণ বন্দোপাধ্যায়, কুলদারঞ্জন রায়, অমৃতলাল গুপ্ত প্রভৃতি সমসাময়িক শক্তিশালী শিশুসাহিত্যিকের বহু গ্রন্থ প্রকাশ করে তৎকালীন বাংলা শিশুসাহিত্যকে ঐশ্বর্য্যশালিনী করে তোলেন।
১৮৯৮-এ প্রকাশিত হয় ‘খেলার সাথী’ ও ১৮৯৯-এ যোগীন্দ্রনাথ সরকার সম্পাদিত ‘খুকুমণির ছড়া’ প্রকাশিত হয়।
১৮৯৯-এ স্নিগ্ধ কৌতুক হাস্যরসে ভরপুর ‘হাসিরাশি’ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯০০-তে প্রকাশিত হয় ‘আষাঢ়ে স্বপ্ন’ এবং ১৯০১-এ ‘লঙ্কাকা-’। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের সংকলন গ্রন্থ ‘বন্দেমাতরম’ যা বাঙালিকে স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। এই বইটি যোগীন্দ্রনাথের স্বদেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
‘বন্দেমাতরম’-এর পর দেখা যায় তাঁর রচনাগুলোর ঝোঁক মূলত পৌরাণিক কাহিনীর দিকে। শিশুদের মতো করে প্রাচীন ভারতের রূপ, পৌরাণিক কাহিনীর উপস্থাপনা এর আগে অন্য কেউ করে যেতে পারেননি। ‘কুরুক্ষেত্র’ (১৯০৯), ‘শকুন্তলা’, ‘সাবিত্রী সত্যবান’, ‘সীতা’ (১৯১০), ‘ধ্রুব’ (১৯১৫), ‘ছোটদের রামায়ণ’ (১৯১৮), ‘ছোটদের মহাভারত’ (১৯১৯), ‘দৈত্য ও দানব’ (১৯২০) প্রভৃতি পুরাণাশ্রিত শিশুপাঠ্য বইগুলো এ সময় প্রকাশিত হয়। এর পাশাপাশি তিনি লিখেছেন ‘মজার গল্প’ (১৯০৫), ‘পশুপক্ষী’ (১৯১১), ‘ছেলেদের কবিতা’ (১৯১২), ‘সাথী’, ‘হিজিবিজি’ (১৯১৬), ‘শিশুসাথী’, ‘হাসির গল্প’ (১৯২০), ‘ছড়া ও কবিতা’ (১৯২১), ‘নূতন পাঠ’ (১৯২২) ইত্যাদি।
১৯২৩ সালে সকলের অজান্তে উচ্চরক্তচাপের কারণে মস্তিষ্কের শিরা ছিঁড়ে জ্ঞান হারান তিনি। বহু চিকিৎসার পর প্রাণরক্ষা পেলেও শরীরের ডান ভাগে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন তিনি। তা সত্ত্বেও শিশুসাহিত্য থেকে সরে আসেননি । অনেক সময় মুখে মুখে তিনি বলতেন আর স্ত্রী গিরীবালা দেবী কাগজে তা লিখতেন। যোগীন্দ্রনাথের বয়স তখন সাতান্ন আর এরপর আরও চৌদ্দ বছর বেঁচেছিলেন তিনি। এসময়ে তিনি একে একে ১৯২৪-এ ‘পঞ্চরত্ন’, ১২২৫-এ ‘আদর্শপাঠ’, ‘উশীনর’, ‘সুভদ্রা’, ‘প্রহ্লাদ’, ‘রত্নাকর’, ১৯২৬-এ ‘লবকুশ’, ‘সুশিক্ষা’, ১৯২৮-এ ‘অন্ধমুনি’, ‘অভিমন্যু’, ‘গান্ধারী’র দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯২৯-এ ‘ছোটদের চিড়িয়াখানা’, ‘বনে জঙ্গলে’, ‘জ্ঞানপ্রবেশ’, ‘শিক্ষাপ্রবেশ’, ‘সপ্তকান- রামায়ণ’ এরকম কত রচনা, সংকলন, সম্পাদনা করেন। ১৯৩৭-এর ২৭ জুন মৃত্যুবরণ করেন শিশুসাহিত্যের এই প্রাণপুরুষ।