রেনু আবারও পালাচ্ছে। এই নিয়ে পনের বার। যাওয়ার সময় সেই বাসার পাশ দিয়ে যেতে যেতে ভাবে- এই বাসাটাতেই বেশি দিন ছিল। কারণ বেগম সাহেবটা মানে মামী বড়ো ভালো মানুষ। গালি নাই, মুখে সবসময় হাসি। কিন্তু সাহেবের মেজাজটা চড়া ছিল। সেবার রমজান মাসে যাকাত, বোনাস আর নানাজনের উপহার মিলে প্রায় বিশ হাজার টাকা। ব্যস! মন খালি উড়ে,উড়ে। তো সেদিন বিকেলে বাজার পাঠিয়েছেন সাহেব। শীতের নতুন ফুলকপি। একেবারে কচি কচি ডাঁটা। মামী বিকেলের চা খেতে খেতে বলেন-‘ও রেনু। কপির ডাঁটা ফেলে দিওনা। ভাজলে বেশ মজা। রেনু সাথে সাথে বলে– ‘কি বলেন! মামী! একেবারে কচ কচ করে খাইয়া ফেলুম’। অথচ! দুপুরে ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে। পালাবে। হাতে নগদ টাকা অনেক। মাগরিব পরে বেগম সাহেব ঢুকলেন নিজের পড়ার ঘরে। দরজা বন্ধ করে এসি চালিয়ে লেখেন তিনি। ব্যস এই সুযোগ! ব্যগ নিয়ে দরজা হাট করে খোলা রেখে সোজা মেয়ের বাসায়।
একমাত্র মেয়ে, গ্রাম থেকে অভাবের জ্বালায় শহরে এসেছে যখন তখন মেয়ের বয়স মাত্র বার বছর। রেনুর এক বোনের মেয়ে থাকতো আগ্রাবাদ সিডিএতে। সে বাসা ঠিক করে দিল। ছুটা কাজ করে মেয়েটাকে নিয়ে এক বস্তিতে। সময় বহিয়া যায়। মেয়েটা ডাঙর হচ্ছে আর রেনুর আশা ও বাড়ে। বস্তির কতো মেয়ে গার্মেন্টস এ কাজ করে। বেতন ও মোটামুটি বেশ ভালো। একসময় মেয়ের চাকরি হয় গার্মেন্টসএ।রেনু ও স্থায়ী চাকরি নিয়ে একটা বাসায়।কিন্তু সমস্যা একটাই। কিছুদিন গেলে বাসাটা আর ভালো লাগে না। পালায় বেশির ভাগ বাসা থেকে। বোনের মেয়ে তখন আশ্রয়। কি আর করা। আপন খালা। অনেক গজগজ করে আবারও বাসা খোঁজে।

দুই.
রেনুর গ্রাম বরিশালের এক গ্রামে।বাবা ছিলেন সচ্ছল গেরস্ত। নিজের কিছু জমি নিয়ে ভালোই কাটছিলো সময়। হঠাৎ এক তুফানে সব হারিয়ে নিঃস্ব। মা যখন মারা যান,রেনুর বয়স তখন মাত্র ছয়। বাবা তখন অন্যের বাড়িয়ে কামলা খাটেন। বিয়েও আর করলেন না। সময় বহিয়া যায়। রেনুর বয়স তখন ষোল। তখন অভাব আর মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে আধবয়সী এক বুড়োর সাথে বিয়ে দিলেন রেনুর। উপায়ও ছিলনা। রেনু গায়ে গতরে বেশ লম্বা চওড়া হলেও দেখতে কালো আর চেহারাও একেবারে সাধারণ। অতএব সেই ঘরে সতীনও ছিলো। ভরা সংসার। কিন্তু সতীনের দিনরাত খোচা আর গালি হজম করে কাজের মেয়ের মতো খাটতো।স্বামী ও বিয়ের পরে একনাগাড়ে দুইমাস থাকলেও ধীরে ধীরে সপ্তাহে দুই বা তিনদিন। রেনু ইতিমধ্যে এক ছেলে ও এক মেয়ের মা।সুখে দুঃখে দিন কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু হুট করে স্বামীটা মরে গেল।
সতীনকে তখন পায় কে। রেনুর দুঃখের জীবনের গল্প শুরু।
ছেলের বয়স তখন ষোল। স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন বাবা।কিন্তু পড়ায় লবডঙ্গ। এক ক্লাশে দুই বা তিন বছর। শেষমেশ বাপ নিয়ে এলেন ক্ষেতে। ওখানেই গতর খাটতো আর অবসরে বন্ধুবান্ধব। বাবা হুট করে চলে যাবে কে জানতো? সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করার সময় পাননি। আগের ঘরের ছেলেরা জমিতে ঢুকতে দিলোনা। একদিন মা’কে বলো–” মা। তুমি চিন্তা করোনা।আমি চট্টগ্রামের বান্দরবানে যাচ্ছি। শুনছি ওখানে কাজ পাওয়া যায়।”
রেনু চিরকালই একটু বোকাসোকা। কিছুই তো বলার নাই। ছেলে চলে গেল পাহাড়ে।
আর রেনু ও একটা সময় চট্টগ্রামে। শুনছে বড়োলোকের জায়গা। না খেয়ে মরে না মানুষ। অতএব।

তিন.
রেনুর মেয়েটা খুব সুন্দর। বাপটা বয়সকালে সুন্দর ছিলো, সেই রঙ আর চেহারাও পেয়েছে। বয়স হিসেবে মায়ের মতো বোকা না।বেশ চলাক, সাথে রঙঢঙ ও জানে।গার্মেন্টসে ঢুকে বছর খানেকের মধ্যে এক বয়সী ব্যবসায়ীর গলায় দিব্যি ঝুলে পড়ে সংসারী।ঐ লোকের আরও একটা বৌ আছে, ময়মনসিংহ গ্রামে থাকে। শহরে রেনুর মেয়ের সাথে সংসার।
সন্ধ্যায় রেনু হাজির।হাতে বড়ো একটা ব্যাগ। মেয়ে বুঝে নিল–আবারও মা ভাগছে। আবারও স্বামীর খোঁচা সহ্য করতে হবে।
পরের দিন সরাসরি বললো –“মা- আর তোমারে রাখতে পারুম না।এবারে ভাইয়ের কাছে গিয়া থাকো।জায়গাতে চেন। কালকেই চইলা যাও।”
রাতে ছেলেকে ফোন দিয়েছে মেয়ে। ছেলে কিছুটা দোনোমোনো করে বললো -“দে।পাঠাইয়া দে”।
পরের দিনে নতুন ঠিকানায় রেনু।আরেক জীবনের গল্প। এক সপ্তাহ ভালোই ছিলো। ছেলে এখানে নিজের বাড়ি করেছে,জমিজমা ও আছে আবার চাকরি ও করে।বেশ স্বচ্ছল। তিন ছেলেমেয়ে। ওরা স্কুলে যায়।রাতে দাদাির সাথে ঘুমায়।
কিন্তু সমস্যা ছেলের বৌয়ের। শুরু হলো বাক্যবাণ। ছেলে কাজে বের হলেই শুরু হয়। খাওয়ার খোঁচা,শরীরের ব্যথার জন্য ছেলে ঔষধ আনে, পান আনে,সেগুলোর খোঁচা।
এরই মাঝে এল মহামারি। ছেলের কাজ নাই, জমি থেকে ফলফলাদি যা পায় তা যে বাজারে নেবে সেই উপায় ও নেই। তারওপর ঘরে দিনরাত অশান্তি। একদিন বলেই ফেলে-” মা,তোমারে এতোগুলা বাসায় কাজ দিল,থাকতে পারলানা কেন্”। এতো অশান্তি আর ভালো লাগে না “।

চার.
ছেলের টেলিভিশন আছে।রেনু শোনে,মহামারি কমছে।কি জানি বলে লক ডাউন উঠে গেছে।এই অপেক্ষায় ছিল। একদিন খুব ভোরে বাসে, আাবারও চট্টগ্রাম। একটা বুদ্ধি করেছিল, বাসাবাড়িতে পাওয়া টাকাগুলো খুব একটা খরচ করেনি। । ট্র্যাংকের একটা কোণায় জমা রেখে দিযেছিল। ভরসা ঐটাই।শহরে একবার এক বাসার বেগমের সাথে একটা বাজারে গিয়েছিল। ওখানে ফুটপাতে দেখেছে অনেক মানুষের বসবাস। আরেকবার এক পরিবার ওকে ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিল। তখন দেখেছে রেললাইনের পাশে ফুটপাতে ও অনেক মানুষ। বেগম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলে বলেছিলেন –” যাদের ঘরবাড়ি নাই তারা ওখানে থাকে।”
রেনু ভাবে — ওরও কেউ নাই। কোথায় থাকা যায়। ভাবতে ভাবতে চলে আসে বাজারের পাশের ফুটপাতে। কোনও মতে একটা ছোট জায়গা করে নেয়।তবে সহজে পায়নি। কিছু টাকা দিতে হয়েছে। রেনুর আরেক জীবনের শুরু।
একটা চাটাই, মশারী আর তিন-চারটা হাঁড়ি পাতিল।
দিনে শহরের নানাজায়গায় ভিক্ষার থালা নিয়ে বসা। সুরে সুরে ভিক্ষা চাওয়া। প্রথম দিনের শেষে রাতে দেখে একশ টাকার কিছু বেশি।
অনেক দিন পরে রাতে খুব আযেশ করে রান্না করে খেতে খেতে ভাবে
–” আল্লাহ! আমার তো কেউ নাই। শুধু শরীরটা ভালো রাইখো। যেন ভিক্ষা করতে পারি। আর মরণ আসলে যেন ঘুমের মধ্যেই চলে যাই। আমার জন্য যেন কেউ না কান্দে। কেউ যেন মরা মুখ ও না দেখে। ওদের জীবনে কাঁটা যেন না হই। ওদের তুমি সুখে রাখো হে আল্লাহ। আমার মতো ভাগ্য যেন কারো না হয়।” আল্লাহ কি শুনছেন হতভাগিনী রেনুর কথা।