শিশুর সাথে শিশুর তরে–বিশ্ব গড়ি নতুন করে।—এই প্রতিপাদ্যে পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ। যদিও প্রশ্ন যেন মনের ভেতরে আবর্তিত হতে থাকে কতো দিবস আমরা পালন করি! কতো ছবি কতো কথা কতো গান! কিন্তু আসলেই কি বিশ্বের সকল শিশু ভালো আছে! বা দেশের!
বাংলাদেশের শিশুরা আার্থ সামাজিক কারণে নানা বিভাজনে বড়ো হচ্ছে। এ বিভাজন ধনী, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির। যারা দরিদ্র বা ছিন্নমূলের নানা নিপীড়ন, বঞ্চনা ও শোষণে –জীবন জীবিকার সংগ্রামে।শিশু অধিকার এখানে প্রশ্নবিদ্ধ।যে শিশু গৃহশ্রমে সেখানে তাদের অনেকের যে ভয়াবহ চিত্র দেখেছি তাতে মানুষ নামের সংজ্ঞা দিতেও লজ্জা হয়।যদিও এখন সেই চিত্রের বিষয়ে প্রায় সবাই নিশ্চুপ। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে তথা পরিবহন খাতে বা নির্মাণ বা জাহাজ শিল্পে কতো কতো শিশু। শিশুদের আত্মরক্ষার সামর্থ্য কম! আরবএ সুযোগ নিচ্ছে অনেকেই।
সাধারণ ভাবে যদি শিশুর কথা বলি তাহলে যেতে হয় শিক্ষা ব্যবস্থায়।লেজেগোবরে এক শিক্ষা ব্যবস্থায় বেড়ে উঠছে আমাদের শিশুরা।একদিকে নানামুখী শিক্ষা ব্যবস্থা অন্যদিকে পরীক্ষা নামক এক বিভীষিকা। নিত্য তাদের মেধা ও মননে যুক্ত হচ্ছে এক অশুভ প্রতিযোগিতা। যার সাথে যুক্ত অভিভাবক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও। ফলাফলের ভিত্তিতে সেরা হওয়ার যে সংস্কৃতি তা অন্য কোন দেশে আছে কিনা সন্দেহ। তো আমরা এক প্রকার ঘোড়া দৌড়ে। ছুটছি আর ছুটছি। স্কুল থেকে কোচিং সেন্টার এরপরে বাসায় এসেও পড়ার টেবিলে। আহা! কি মধুর এক শৈশব!
আমাদের শৈশবের সেই নির্মল আনন্দ থেকে কিভাবে বঞ্চিত শিশুরা।বইয়ের বোঝা নেই, সিলেবাসের তেমন চাপ নেই। ছিল সাংস্কৃতিক চর্চার সাথে সৃজনশীল জগত ও খেলাধুলা। এখন মাঠ নেই, পার্ক নেই আর প্রাকৃতিক পরিবেশের মাধুর্য ও হারিয়ে গেছে ফ্ল্যাট সংস্কৃতিতে।সুবচন শিক্ষা ও ছিল। দিন কয়েক ধরে ইশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাল্যশিক্ষার প্রদর্শন ফেসবুকে।
এখন আছে গাইড বুক! সৃজনশীল পদ্ধতি এসেছিল শিশুর সৃজনশীল বিকাশে। কিন্তু শিক্ষকরা কি সবাই সৃজনশীল! আছে কি যথাযথ প্রশিক্ষণ। এগুলোতে প্রাক প্রস্তুতি না নিয়ে চলে এলো সৃজনশীল পদ্ধতি। অতএব গাইড বুকের আশ্রয়ে প্রশ্ন পত্র প্রণয়নের নানা অভিযোগ। অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে। আমাদের শিশুরা হচ্ছে গিনিপিগ। একবার এদিক তো আর একবার ওদিক।অভিভাবকদের অবস্থা ও ত্রাহিত্রাহি।
তো পরিবার!! এখন আমরা নিউ ক্লিয়ার পরিবারে।রুপকথা বা কল্পনার জগতে নেওয়ার দাদা বা নানারা নেই। আছেন বাবা ও মা।অনেক পরিবারে দুজনেই কর্মজীবী। সুতরাং কারো সময় নেই। ছোট্ট যে শিশু তার হাতেও মোবাইল! দৃষ্টি কার্টুনে!!আবার পরিবারের স্বামী স্ত্রীর সহাবস্থানের ক্ষেত্রেও অনেকের ইগো সমস্যা বা তৃতীয় পক্ষ। সুতরাং হয়তো লেগে থাকে বিবাদ বা অশান্তি। তখন অনেকে একবারও শিশুর মনোজগতের কথা ভাবেনা।এদের অনেকে বিষন্নতায় বা আগ্রাসী আচরণের হয়ে ওঠে। ফলশ্রুতিতে দেখি কিশোর গ্যাং। সূদুর অতীতেও যা দেখিনি তাই দেখতে হচ্ছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের সবাই কি শিশু বান্ধব!! জগাখিচুরি পরীক্ষামুখী সিলেবাস,শিক্ষক –শিক্ষার্থী অনুপাতে অসামঞ্জস্য,যথাযথ প্রশিক্ষণ বিহীন শিক্ষক –সব কিছু মিলিয়ে শিশু শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের সম্পর্ক কেমন!তাদের আবেগীয়,নৈতিক, শারীরিক ও মানসিক বিকাশ যথাযথ ভাবে হচ্ছে কিনা তা নিয়ে কি ভাবছি আমরা!শিক্ষকদের সাথে পরিবার বা অভিভাবকের সংযোগ আছে কিনা বা পাঠ্যক্রমের বাইরে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কাউন্সেলিং হয় কিনা বা পাঠদান! এসবের গুরুত্ব অনেক।
শুধু দিবস পালনে সীমাবদ্ধ না থেকে শিশুদের নিয়ে ভাবা দরকার। ওরাই আগামী দিনের সম্পদ!ওদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের বিষয়টি গভীরভাবে ভাবতে হবে পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্রকে।পরীক্ষা কেন্দ্রিক শিক্ষার পরিবর্তে দরকার জ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা। আনন্দ নির্ভর শিক্ষার সাথে নৈতিক তথা মানবিক শিক্ষা। আমাদের প্রত্যাশা প্রতিটি পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়ে উঠুক শিশু বান্ধব। একই সাথে সামাজিক সংগঠনের সাথে এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকেও।