বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতের দিকপাল ছিলেন মরহুম তোয়াব খান। ভিন্ন ধরনের এক মানুষ।বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারি থেকে জনকণ্ঠের সম্পাদক। তিনি যখন নতুন পত্রিকা জনকণ্ঠের হাল ধরেন তখন সেটি ই একমাত্র কাগজ যা ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম সহ চার শহর থেকে একযোগে বের হতো। রমরমা বাজারের কাটতিতে জনকণ্ঠ তখন এক নাম্বার পত্রিকা।
দেশ ছাড়ার আগে প্রয়াত শিশু সাহিত্যিক অভিভাবক তুল্য এখলাস উদদীন আহমদ ও বন্ধু সাংবাদিক আলী হাবিবের কারণে জনকণ্ঠের ছোটদের পাতায় লিখতাম। লেখা শুরু করেছিলাম উপসম্পাদকীয় পাতা চতুরঙ্গে। সিডনি বাসের বছর কয়েক পর বিরূপাক্ষ আমেরিকা চলে গেলে নতুন নামে সিডনির মেলব্যাগ লেখার ভার পড়লো আমার কাঁধে। দুঁদে সম্পাদক তোয়াব ভাই। রাশভারী মানুষ। তাঁর সাথে ভয়েই কেউ কথা বলে না। লেখা ছুঁড়ে ফেলে দিতে যেমন তেমনি ভালো লেখা ছাপতেও কোন সমস্যা ছিল না তাঁর। বিগত ২১ বছর ধরে এই কলামটি লিখে চলেছি আমি।যদিও বয়স এবং ব্যস্ততায় এখন প্রতি সপ্তায় লিখতে পারি না। বলছিলাম তোয়াব ভাইয়ের কথা। মধ্যরাতে ঘুম ভাঙিয়ে লেখার জন্য ফোনে বকা দিলেও সবসময় স্নেহ দিয়েছেন। যতবার ঢাকা যেতাম তাঁর সাথে দেখা হতো। শেষে এমন হয়ে গেছিল ফোনে দীর্ঘ সময় কথা বলতাম। নব্বই বছরেও সচল ছিলেন প্রবীণ সম্পাদক তোয়াব খান, যিনি প্রশ্রয় না দিলে কখনোই কলাম লেখক হতে পারতাম না। কত নেগেটিভ ফোন কল, কত বিরূপ চিঠি, কত অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে, তিনি গলেন নি। বরং স্নেহধারায় ভাসিয়ে দিয়ে গেছেন যতদিন বেঁচে ছিলেন।
দৈনিক আজাদীর সাথে সখ্য গড়ে ওঠে নব্বই এর শুরুতে। বন্ধু বান্ধব সবাই তখনকার ঝলমলে পূর্বকোণে। একা আজাদীর সাথে থাকাটা সহজ ছিল না। প্রয়াত অরুণ দাশগুপ্ত, নাট্যকার প্রদীপ দেওয়ানজী প্রিয় শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক রাশেদ রউফ এরাও তখন লড়াই করছেন। এই সময়কালে আজাদী সম্পাদক বর্ষীয়ান রাজনৈতিক লিজেন্ড প্রয়াত প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদের সাথে পরিচয়। অচিরেই তাঁর সাথে গড়ে ওঠে অসম বয়সী এক চমৎকার নিবিড় সম্পর্ক। তিনি কখনো আপনি ছাড়া তুমি বলতেন না। সান্ধ্য আড্ডার পর সীমিত মানুষের একটি নৈশ আড্ডা বসতো অরুণ দা’র বাসায়। সে আড্ডায় বাড়ির খাবার নিয়ে আসতেন অধ্যাপক সাহেব। এভাবে গল্প ও আহারে কিভাবে যেন তাঁর স্নেহের ছায়ায় পড়ে গেছিলাম। যে বার পবিত্র হজ্ব করতে গেলেন ফিরে আসার পর ছোট একটি আতরের কৌটো উপহার দিয়েছিলেন সলজ্জ আন্তরিকতায়। বহু বছর সেটি যত্ন করে তুলে রেখেছিলাম। এখন সে শিশিটি নেই। নেই অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ যিনি শেষবার হাঁপানি জনিত অসুস্থতার পরও আজাদী অফিসে এসেছিলেন দেখা হবে বলে। শেষ দেখার সৌজন্য ও স্নেহ বুকের ভেতর রাখা থাকলেও ছবি নেই। তখন ছবি তোলার কী এমন সুযোগ ছিল?
বজলুর রহমান। সংবাদ সম্পাদক, রাজনীতিবিদ, মতিয়া চৌধুরী’র স্বামী। তখন আমি সংবাদের নিয়মিত লেখক। সংবাদে কলাম ছাপা মানে তখন অনেক কিছু। আমার অকাল প্রয়াত মেধাবী কবি বন্ধু শাহিদ আনোয়ার ছিল সাংবাদিক। পূর্বকোণের ডেস্কে কি কথা হতো জানি না ও রোজ এসে একটা কথাই বলতো। তুই যদি সংবাদে লিখতে না পারিস গ্রহণযোগ্যতা পাবি না। সেই জেদ ও সংকল্পে সংবাদে কলাম ও সাময়িকীতে লিখেছি।এমন সম্পর্ক হয়ে গেছিল যে সিডনি আসার পর বছর কয়েক নিয়মিত সংবাদ আসতো ডাক যোগে। বজলুর রহমান যতোই গম্ভীর মানুষ হন না কেন ফেব্রুয়ারির এক সকালে সংবাদ অফিসে দুজনের আড্ডা গড়িয়ে অপরাহ্নে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু মর্মান্তিক হলেও সত্য সে দিনের পর আমি কলকাতা ঘুরে সিডনি আসার এক সপ্তাহের ভেতরেই পরলোকে পাড়ি জমান বজলু ভাই। যিনি না হলে কলার উঁচু করা কলাম লেখক হতেই পারতাম না।
প্রয়াত রাহাত খান সহ জীবিত কিংবদন্তী অনেক সম্পাদকের এমন ভালোবাসা ও স্নেহ আমাকে বারবার ঋদ্ধ করেছে।
সবশেষে বলবো চট্টগ্রামের অভিভাবক স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র, চট্টল গৌরব আমার প্রিয় আজাদী’র সম্পাদকের কথা । আজাদীতে লিখলে যে সুখ ও প্রশান্তি তা কি অন্য কোথাও মেলে? আমি কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁকে। এই অক্টোবর মাসে তাঁর সাথে দেখা হলো শিশু সাহিত্য একাডেমির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। অমায়িক ভদ্রলোক। সেন্স অফ হিউমার যে কত উঁচুতে তা ঘনিষ্ঠ ভাবে কথা না বললে আড্ডা না দিলে অজানাই থেকে যেতো।
সময় ও তারিখ ঠিক করে এক দুপুরে আজাদী অফিসে গল্প করার সুযোগ হয়েছিল। হেন কোন বিষয় বাদ পড়ে নি যা নিয়ে আলাপ করা যায়। তাঁর সৌজন্য ও আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত। সেটি আমি সিডনিতে বসে তাঁর প্রেরিত স্মারকগ্রন্থটি পেয়েই জেনে গিয়েছিলাম।
এবার একসাথে খাবারও আড্ডা দেয়ার আমন্ত্রণ বানচাল করে দিয়েছিল ডেঙ্গু। অবশ্য ফেরার সময় এ জন্য মার্জনা চেয়ে ভবিষ্যৎটা বুকড করে এসেছি।
সত্যি বলতে কী এখনো তরুণ, এমন প্রাণবন্ত, উদার ও হাস্যোজ্জ্বল মানুষ বিরল। তাঁর ছায়ায় দৈনিক আজাদী ক্রমাগত তার ডানা মেলে চলেছে। এই যাত্রা চট্টগ্রাম তথা দেশের সংবাদপত্র জগতের অহংকার।
জন্মদিনে আজাদী সম্পাদক জনাব, এম এ মালেকর শতায়ু কামনা করি। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন। শুভ জন্মদিন।