নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথা উঠলেই প্রথমে যাঁর কথা মনে পড়ে সে হল ‘অমলকান্তি’। কবি লিখেছেন,
‘অমলকান্তি আমার বন্ধু..
আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল !
সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।’
শুধু অমলকান্তি কবিতা কেন, মনে পড়ে তার লেখা কাব্যগ্রন্থ ‘উলঙ্গ রাজা’ কিংবা কলকাতার যীশু নামের কবিতার কথা । কবিতায় ছোট্ট শিশুকে দিয়ে রাজাকে কবি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়’? আজ তার ৯৭ তম জন্মবার্ষিকী। এইদিনে শৈলী টিভি অনলাইন পত্রিকার পক্ষ থেকে আমরা তাকে বিশেষভাবে স্মরণ করছি।
নীরেনের জন্ম ১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর তারিখে ফরিদপুর জেলার চান্দ্রা গ্রামে। তাঁর প্রাথমিক লেখাপড়া ফরিদপুরের পাঠশালায়। ১৯৩০ সালে পাড়ি জমান কলকাতায়। কলকাতায় এসে প্রথমে কলকাতার বঙ্গবাসী স্কুলে এবং পরে মিত্র ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। ১৯৪০ সালে ‘প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪২ সালে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে আই. এ. পাশ করেন। ১৯৪৪ সালে সেন্ট পলস্ কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে বি. এ. পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় ‘শ্রীহর্ষ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
মাত্র ৫ বছর বয়সে তিনি প্রথম কবিতাপ লেখার মধ্যদিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। কিন্তু সেটা কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। ১৬ বছর বয়সেই ‘শ্রীহর্ষ’ পত্রিকায় কবিতা লেখার মধ্যে দিয়েই সাহিত্যজগতে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ হয়। ‘দৈনিক প্রত্যহ’ পত্রিকায় তাঁর সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। ‘সত্যযুগ’ পত্রিকার সাংবাদিকরূপে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি একে একে ‘মাতৃভূমি’, ‘স্বরাজ’, ‘ভারত’, ‘ইউনাইটেড প্রেস অফ্ ইন্ডিয়া’ প্রভৃতি পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৫১ সালে যোগ দিয়েছিলেন ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায়। তিনি সম্পাদনা করেছেন শিশু কিশোর পত্রিকা ‘আনন্দমেলা’। তার হাত ধরেই বাংলা কিশোর সাহিত্য আরো বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়েছিলো। শিশু কিশোরদের জন্য তার ছড়া গ্রন্থগুলো মধ্যে ‘শাদা বাঘ’ ‘বিবির ছড়া’ উল্ল্যেখযোগ্য। নীরেন্দ্রনাথের প্রথম কবিতার বই ‘নীল নির্জন’, প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। এরপর প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা ‘অন্ধকার বারান্দা’, ‘নীরক্ত করবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, কলকাতার যিশু, খোলা মুঠি, কবিতার বদলে কবিতা, ‘আজ সকালে’ পাগলা ঘণ্টি’, ‘ঘর দুয়ার’, ‘সময় বড় কম’, ‘ঘুমিয়ে পড়ার আগে’, ‘দেখা হবে’ সহ অসংখ্য কবিতার বই। কর্মজীবন শেষে ৫০ বছর বয়সে কলকাতার পাট চুকিয়ে বাংলাদেশের ফরিদপুরের বাড়ি চান্দ্রা গ্রামে চলে আসেন।
‘বাংলার কবিতা ও সাহিত্যে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর লেখা বেশকিছু ছোটগল্প ও উপন্যাস সাহিত্যপ্রেমীর কাছে কাছে চিরপ্রিয় হয়ে থাকবে। ‘ছন্দের ক্লাস’ ও ‘পিতৃপুরুষ’ নামে তার দুটি প্রবন্ধের বই রয়েছে। উলঙ্গ রাজা কাব্যগন্থের জন্য ১৯৭৪ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান তিনি। এছাড়াও ১৯৯৪ সালে উল্টোরথ পুরস্কার, ১৯৭০ সালে তারাশঙ্কর স্মৃতি, ১৯৭৬ সালে আনন্দ শিরোমণি পুরস্কার পান তিনি। ২০০৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাকে ডক্টরেট প্রদান করে। ২০১৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।