‘মাস্টারদা, আপনি কি হাতঘড়ি পরতেন কখনো?
এই প্রশ্ন আমাকে ঠোকর মেরেছে
অনেকবার। মাস্টারদা, আপনার বিষয়ে
অনেক কিছুই জানা আছে আমার।’- শামসুর রাহমান

বৃটিশ বিরোধি আন্দোলনের সূতিকাগার চট্টগ্রামের প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন কিংবদন্তি পুরুষ জে.এম. সেন-এর বাড়ি দখলের খবরে চট্টগ্রাম সিটি কপোরেশনের প্রশাসক জনাব খোরশেদ আলম সুজন বলেছেন, ‘ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা যাত্রা মোহন সেনগুপ্তের দেড়’শ বছরের পুরনো বাড়িটি শুধু আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষার স্থান না। এটি বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের সাহসী তরুণের সাহসী ঠিকানা। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা জে এম সেনের বাড়ি দখলের চেষ্টা জাতিসত্তার ইতিহাস মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র’। উদ্বেগজনক এই প্রতিক্রিয়া পাঠ করে মনে পড়ে, নিকট কিংবা দূর অতীতের নানান সব ষড়যন্ত্রের কথা। এই ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যকে অবজ্ঞা করছে প্রতিনিয়ত। তারা ইতিহাসের দ্বার উদঘাটন করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টে। এভাবেই পালাবদল আর পদাঙ্ক অনুসরণের ইতিহাস রচিত হচ্ছে। ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে নিয়মিত। আজকের দিনেও ষড়যন্ত্রকারীদের এমন আস্ফালন দেখে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনের ফাঁসির দিবসে (১২ জানুয়ারি) ভয়ার্ত কন্ঠে উচ্চারণ করতে বাধ্য হই,মাস্টারদা সূর্যসেনকে যেন ভুলে না যাই।
গত শতকের তৃতীয় দশকে বিশাল সাম্রাজ্যের নৃপতি ব্রিটিশ রাজশক্তির বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিপ্লবী সূর্যসেনের নেতৃত্বে মাত্র ৬৩ জন তরুণ সমগ্র চট্টগ্রামকে তিনদিনের জন্য ব্রিটিশ রাজশক্তির নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের মহানায়ক সূর্যসেন এবং ত্যাগী সাথীদের সেই গৌরবোজ্জ্বল বীরগাঁথা আজ আর আমাদের ইতিহাসে নেই।
১৮৯৩ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রাম জেলার নোয়াপাড়া গ্রামে যুব বিদ্রোহের প্রাণপুরুষ সূর্যসেন জন্মগ্রহণ করেন। সূর্যসেন ছেলেবেলা থেকেই লেখাপড়ায় খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। স্কুলে পড়ার সময়ে তিনি বিপ্লবী দলের খবরাখবর রাখতেন। গোপনে ব্রিটিশ সরকারের বেআইনী ঘোষিত রাজনৈতিক বই পড়তেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯১৬-১৭ সালে তিনি প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবী দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
১৯১২ সালে চট্টগ্রামের নন্দনকাননের হরিশ দত্তের ন্যাশনাল স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাশ করে সূর্যসেন চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে আই.এ পাশ করে বি.এতে ভর্তি হন। সূর্যসেন বিএ ১ম বর্ষের সাময়িক পরীক্ষায় ক্লাসে কিছুক্ষণ পড়ার জন্য একটা বই নিয়ে কলেজে যেতেন। অন্যমনস্ক সূর্যসেন বইটা অধ্যাপক বা বাইরে অন্যকারো হেফাজতে রাখতে ভুলে যান। বইটা তাঁর পাশে টেবিলের ওপর পড়ে থাকে। এদিকে পরীক্ষা শুরু হলে চট্টগ্রাম কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ পরীক্ষা কক্ষে এসে দেখেন সূর্যসেনের পাশে বই। অধ্যক্ষ এটা ভালোভাবে নেননি। তাঁকে কোনোভাবেই বুঝানোও গেল না যে, ভুলবশত বইটা রয়ে গেছে, নকলের ইচ্ছে নিয়ে ওটা ওখানে রাখেননি। কারণ নকলের ইচ্ছে থাকলে সূর্যসেন বইটা সূর্যসেন টেবিলে না রেখে লুকিয়েই রাখতেন। কিন্তু অধ্যক্ষ কোনো অজুহাতই শুনলেন না। সূর্যসেনকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করেন। তারপর সূর্যসেন কোলকাতার বহরমপুর কলেজে বিএতে ভর্তি হন। ১৯১৮ সালে তিনি বিএ পাশ করেন।
শিক্ষাজীবন শেষে চট্টগ্রামে ফিরে আসরে সূর্য সেনের অভিভাবকরা তাঁকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু মাস্টারদা বিয়েতে কিছুতেই রাজী হচ্ছিলেন না। অভিভাবকদের ক্রমাগত চাপের কারণে অবশেষে তিনি চট্টগ্রামের কানুনগোপাড়া গ্রামের নগেন্দ্র নাথ দত্তের মেয়ে পুষ্প দত্তের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু দেশমাতৃকার সেবায় আত্মনিবেদিত প্রান সূর্যসেন ফুলশয্যার রাতে স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের আগেই রাতের আধাঁরে গৃহত্যাগ করেন।এরপর আর কোনোদিন সূর্যসেন স্ত্রীর সঙ্গে সাক্সাৎ করেননি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর জেল থেকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে একবার শুধু এ পলক দেখতে এসেছিলেন।
সূর্যসেন অম্বিকা চত্রæবর্তীর সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানজী পুকুর পাড়ে ‘শান্তি আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করে এখানেই থাকতেন। প্রথম দিকে ওটাই ছিল তাঁর ঠিকানা। এ সময় এখানে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা নিয়মিত আসতেন। কোলকাতায় পত্রিকা সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে বিপ্লবীরা অনুশীলন আর যুগান্তর দলে বিভক্ত হয়ে পড়লে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা কোনো পক্ষে না গিয়ে স্বতন্ত্র ধারা সৃস্টির সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু অচিরেই বিপ্লবী চারু দত্ত ভিন্নমত পোষণ করে চট্টগ্রামে অনুশীলন দরের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার কথা ঘোষণা করেন। এতে বিক্ষুদ্ধ অপর বিপ্লবীরা সূর্যসেনকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চাপ দেয়। সূর্যসেন চারুদত্তকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেন। কিছুদিন পর অবশ্য অন্যদের নিয়ে যুগান্তর দলে যোগদান করেন। অনুশীলন ও যুগান্তর দলের এই বিভক্তি ছিল অনেকাংশে ব্যক্তিত্বের সংঘাত। আদর্শ একানে তেমন কোনো মুখ্য বিষয় ছিল না। আর এই বিভক্তিকে কেন্দ্র করে ঐ সময় দুপক্ষের মধ্যে ানেক সংঘর্ষও হয়। চট্টগ্রামেও এর প্রভাব পড়ে। দুপক্ষের সংঘর্ষে এক বিপ্লবীর মৃত্যুও ঘটে।
এ সময় দলের অর্থ সংগ্রহ করার জন্য বিপ্লবীরা ডাকাতির সিদ্ধান্ত নেন। চট্টগ্রামে প্রথম রাজনৈতিক ডাকাতি হয় আনোয়ারা থানার পড়য়কোরা গ্রামের এক হিন্দু জমিদারের বাড়ি। ডাকাতির মাধ্যমে অর্ঝিত সতের হাজার টাকা বিপ্লবীরা অস্ত্র কেনার জন্য কোলকাতা পাঠান। এ সময় সূর্যসেন উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন।
সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশ রাজশক্তিকে পরাজিত করার প্রত্যয়ে সূর্যসেন আন্দোলন সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। তিনি এই সশস্ত্র আন্দোলনের সূচনা হিসাবে চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামির কাছে নাগর পাহাড়ে প্রথমবারের মতো পুলিশের সঙ্গে খন্ড যুদ্ধে অংশ নেন। নাগর পাহাড়ের খুব কাছাকাছি জালালাবাদ পাহাড়ে এর সাতবছর পর মাস্টারদা সূর্যসেন আর চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তাই নাগর পাহাড়ের এই খন্ড যুদ্ধকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ের (জালালাবাদ যুদ্ধ) মহড়া হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।
নাগর পাহাড়ের এই খন্ড যুদ্ধে সূর্যসেন অম্বিকা চক্রবর্তীসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। সেবার তাঁদের বেশিদিন জেল ঝবিন ভোগ করতে হয়নি। লব্ধ প্রতিষ্ঠিত ব্যারিষ্টার দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের সূক্ষ আইন জ্ঞান ও তীক্ষ বুদ্দিমত্তায় পরিচালিত মামলায় সূর্যসেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী নিঃশর্ত মুক্তি লাভ করেন।
মাস্টারদা সূর্যসেন তৎকালীন সময়ে ভারতীয় কংগ্রেস দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও গান্ধী ঘোষিত অহিংস রাজনীতির ভাবধারার বিরোধী ছিলেন। সে ক্ষেত্রে নেতাজী সুভাস বসুর অনুসৃত নীতির প্রতি তাঁর অকুন্ঠ সমর্থন ছিল। যুগান্তর ও অনুশীলন দলকে কেন্দ্র করে অচিরেই বাংলার খংগ্রেস চরমপন্থী ও নরমপন্থী গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যুগান্তর সমর্থন চরমপন্থী দলের নেতৃত্বে ছিলেন সুভাস বসু এবং দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেন নরমপন্থী দলের নেতৃত্বে ছিলেন।
১৯২৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর কোলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে আন্দোলনের রণকৌশল নিয়ে জাতীয় নেতাদের মধ্যে মনভিন্নতা দেখা দিলে সূর্যসেনের নেত্বত্বে অনন্ত সিংহ, গনেশ ঘোষ, নির্মল সেন এবং লোকনাথ বল প্রমুখ যুগান্তরপন্থীরা নেতাজী সুভাস বসুর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। অপরদিকে চারু দত্তের নেতৃত্বে অনুশীলনপন্থী চট্টগ্রামের অপর একটি দল দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনের পক্ষে সমর্থন প্রদান করেন। তবে এরা ছিল সংখ্যায় খুবই কম।
জাতীয় নেতৃত্বের এই সংকটময় মুহূর্তে চট্টগ্রামের যুগান্তরপন্থী বিপ্লবীরা মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, কারো নির্দেশের অপেক্ষা না করে চট্টগ্রাম থেকে এককভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করবেন। তরুণ মনের এই আগ্রহ ও উত্তেজনাকে সুপথে চালনা করার প্রত্যয়ে চট্টল গৌরব মাস্টারদা সূর্যসেন তাঁর অনুসারীদের নিয়ে ১৯২৯ সালের মে মাসে চট্টগ্রামের জে.এম সেন হলে রাজনৈতিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। এ সম্মেলনে সভাপত্বি করেন নেতাজী সুভাস বসু। সূর্যসেনের আমন্ত্রণে এই রাজনৈতিক সম্মেলনে অনেক সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দ যোগদান করেন। এ সময় মাস্টারদা সূর্যসেনের নির্দেশে তৎকালীন সময়ের সর্বাধিক জনপ্রিয় ছাত্রনেতা লোকনাথ বলের সভাপতিত্বে ছাত্র সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়। এই দুই সম্মেলনের সার্থকতা এবং দেমের বিরাজমান অস্থিতিশীলতার সুযোগে সূর্যসেন সশস্ত্র বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সূর্যসেনের নির্দেশে এই বিদ্রোহকে সার্থক করে তুলতে তরুণ বিপ্লবীরা নিজ নিজ পরিবার থেকে টাকা, বন্দুক ইত্যাদি সংগ্রহ করে মাস্টারদার হাতে তুলে দেন। এ সময় অনেক মা এবং বোন নিজেদের শরীর থেকে অলঙ্কার খুলে বিপ্লবীদের ফান্ডে জমা দেন। এ সময়ে লোকনাথ বলের এক ভাই সুবোধ বল (অধ্যাপক ড. অনুপম সেনের শ্বশুর) মায়ের কয়েক ভরি ওজনের একটা হার মায়ের অজ্ঞাতে বিক্রি লব্ধ অর্থ মাস্টার হাতে তুলে দেন।
১৯৩০ সালের জাতীয় সপ্তাহের শেষ দিন চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেস অফিসে সূর্যসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সব আয়োজন সর্বসম্মতিক্রমে সম্পন্ন হয়। বিপ্লবীরা আয়ারল্যান্ডের বিপ্লবীদের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের আর্দশে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের দলের নামকরণ করেন ‘ভারতীয় রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা’। এর সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত হন মাস্টারদা সূর্যসেন। মাস্টারদা তাঁর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ছয়জন সহকারি নির্বাচন করেন। এই সহকারিদের মধ্যে সবচেয়ে তরুণ ছিলেন লোকনাথ বল। এছাড়াও মাস্টারদা ৬৩ জনের একটি সৈন্যবাহিনী গঠন করা করেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, মাস্টার নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী এই স্বাধীনতা সংগ্রামে বল পরিবারের মোট ১১ জন সদস্য অংশগ্রহণ করেছিলেন। একটি বিপ্লবী দলে এক পরিবারের এতজন মানুষের সক্রিয় অংশ্রগ্রহণ তখন তো বটেই আজকের দিনেও খুবই বিরল ঘটনা। এ কারণে ইংরেজ পুলিশের বিশেষ দৃষ্টি ছিল এ পরিবারের প্রতি। যখন-তখন এসে তল্লাশি চালাত। অনেকদিন গেছে রান্না করা ভাত খেতে পারেননি বল পরিবারের মা-বোনেরা অন্য ছেলে-মেয়েরা। পুলিশ এসে উল্টে-পাল্টে নষ্ট করে দিয়ে গেছে তল্লাশীর নামে দিনের জন্য রান্না করা যতসব খাবার।
১৯৩০ সালে ১৮ এপ্রিল শুক্রবার গুড ফ্রাইডে। এদিন চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা মাস্টারদার নেতৃত্বে দেশমাতৃকাকে সাম্রাজ্যবাদীদের কবল থেকে মুক্ত করতে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন। ১৮ এপ্রিল সকালে জেলা কংগ্রেস অফিসে বিপ্লবীরা ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ হয়ে সর্বাধিনায়ক সূর্যসেনের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। মাস্টারদা জানালেন, রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে আক্রমণ শুরু হবে। এখানেই ঠিক হলো অনন্ত সিংহ আর গনেশ ঘোষের নেতৃত্বে গনেশ ঘোষের বাসা থেকেই পুলিশ আর্মারি আক্রমণ করবে। রেলওয়ে আর্মারি নির্মল সেন আর লোকনাথ বলের নেতৃত্বে লোকনাথ বলের বাসা থেকে মোটর যোগে যাত্রা করবেন। সফল আক্রমণ শেষে গভীর রাতে বিজয়ীরা ফিরে আসলে স্বাধীন চট্টগ্রামের জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়। লোকনাথ বলের নেতৃত্বে দলের সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এসসময় সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা একটি সামরিক বিবৃতি পাঠ করেন।
এরপর নানার ঘটনার প্রেক্ষিতে বিপ্লবীরা একের পর এক স্থান ত্যাগ করে অবশেষে জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেন। আসে ঐতিহাসিক ২২ এপ্রিল। এদিন মাস্টারদার নির্দেশে বিপ্লবী লোকনাথ বলের অধিনায়কত্বে ইংরেজদের সঙ্গে এক ভয়াবহ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় বিপ্লবী বাহিনী। সারদিনের তুমুল লড়াই শেষে ব্রিটিশ বাহিনীকে সেদিন পিছু হটতে হয়েছে। এ যুদ্ধে ১৩ জন বিপ্লবী শহীদ হন। এঁরা হলেন : হরিগোপাল বল (টেগরা), প্রভাস বল, মতি কানুনগো, শশাঙ্ক দত্ত, নির্মল লালা, জীতেন্দ্র দাশগুপ্ত,মধু দত্ত, পুলিন ঘোষ, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেন, বিধু ভট্টাচার্য্য ও অর্ধেন্দু দস্তিদার (তিনি গুরুতর আহত হলে পরের দিন ২৩ এপ্রিল মারা যান)। আত্মসমর্পণের পরিবর্তে অমরেন্দ্র নন্দী আত্মহননের পথে বেছে নেন ২৪ এপ্রিল। এই সময় বিপ্লবী অম্বিকা চক্রবর্তী এবং বিপ্রবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী গুরুতর আহত হন।
এরপর আবার শুরু হলো মাস্টারদার পলাতক জীবন। এই পলাতক জীবন যাপনের সময়ে বিপ্লবীরা মাস্টারদা সূর্যসেনের নির্দেশে আরও একাধিক বার যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এর মধ্যে অন্যতম হলো ৬ মে ১৯৩০ সালে কালারপোল যুদ্ধ-এতে শহীদ হন স্বদেশ রায়, রজত সেন, মনোরঞ্জন সেন ও দেব প্রসাদ গুপ্ত; ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে আত্মাহুতি প্রদান করেন।
১৯৩৩ সালে ১৬ ফেব্রæয়ারি গৈরলা যুদ্ধে মাস্টারদা ইংরেজ বাহিনীর হাতে বন্ধী হন। বিপ্লবী রঞ্জন সেনের বড় ভাই নেত্র সেন ব্রিটিশ ঘোষিত পনের হাজার টাকার লোভে পুলিশে খবর দেয়। বাংলার ইতিহাসকে আর একজন মীরজাফর সামান্য অর্থের লোভে কলঙ্কিত করল। ১৯৩৪ সারের ১২ জানুয়ারি মাস্টারদা সূর্যসেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদারকে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদ ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে হত্যা করে। ফাঁসিতে হত্যার পর দুজনের মৃতদেহ গোপনে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া হয়। মাস্টারদাকে যখন ফাঁসিতে ঝুলানো হয়, তখন চট্টগ্রাম কারাগারের সব বিপ্লবীরা ইনকিলাব জিন্দাবাদ, স্বাধীন ভারত কি জয়, মাস্টারদা জিন্দাবাদ- ¯েøাগানে প্রকম্পিত করে তুলে। তখন মাস্টারদা দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেন-‘বন্ধুগণ বিদায়, চিরবিদায়। বিপ্লবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে। বন্দে মাতরম, ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’ বিপ্লবীরাও তাঁর সঙ্গে কন্ঠ মিরিয়ে তাঁকে বিদায় জানায় নিজ নিজ অন্ধ প্রকোষ্ঠ থেকে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে এভাবে বিদায় জানানোর জন্য কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না। কেউ জানত না সমস্বরে একই আওয়াজ বের হবে বন্ধীদের কন্ঠ থেকে। এমনকি এটা বন্দীরাও একে অপরকে আগে জানিয়ে রাখেনি। এর আগে লোকনাথ বল এবং অন্য বিপ্লবীদের বিচারে দীপান্তর সাজা হয়ে এদের বন্দী অবস্থায় আন্দামানে পাঠানো হয়। এভাবেই একটি সম্ভাবনাময় বিপ্রবের যবনিকাপাত ঘটল। সূর্যসেনের নেতৃত্বে নেতৃত্বে চট্টগ্রামের এই বিপ্লবী বাহিনী ব্রিটিশ সাম্যাজ্যবাদের দৃঢ়ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল বটে কিন্তু চ্গ্রামের ঐ বিপ্লবী বাহিনী পরিপূর্ণ কোনো রাজনৈতিক অবয়ব পায়নি সাংগঠনিক শক্তির অভাবে। এই ব্যর্থতা তখনকার ভারতবর্ষের আপনকামী নেতৃত্বের আর অবিকশিত কমিউনিস্ট আন্দোলনের। তবু সূর্যসেনের নেতৃত্বের স্বাধীন চট্টগ্রাম ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রান্তকে উজ্জীবিত করেছে স্বাধীনতার মন্ত্রে। যদিও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আপস ফর্মলা প্রসবিত ফসল। তবু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে আলোচনার টেবিলে আনার জন্য বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, নাট্যজন, প্রাবন্ধিক