বাংলা নববর্ষ এলেই প্রাণের মাঝে কী এক দারুন আবেগে বেজে ওঠে রবীন্দ্রনাথ সেই চিরায়ত গান, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো তাপস নিঃশ্বাস বায়ে’ এ যেন বাঙালির চিরায়িত গান। আমাদের টেনে নিয়ে যায় সকল জরা-জীর্ণতা পিছু ফেলে নতুনের আবাহনে নতুন করে জেগে ওঠার প্রত্যয়ে। এই বাংলা সনের সাথে আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির অনেক কিছুই জড়িত। ঘরে ঘরে বয়ে যায় আনন্দ হিল্লোল। এই বাংলা নববর্ষ ঘিরে হালখাতা খোলা বাঙালিদের একটি চিরকালীন রীতি। আমাদের দেশে ব্যবসায়ী যারা দেশীয় রীতিনীতিতে হিসেব নিকেশ করেন তাদের মধ্যে নববর্ষের এই দিন হালখাতা খোলার দিন হিসেবে এখনো বিবেচিত। গ্রামে গঞ্জে পাড়া মহল্লায় এই নববর্ষের হালখাতা খোলার রীতি প্রচলিত আছে। ব্যবসায়ীরা মিষ্টিমুখ করিয়ে হালখাতা খুলে নতুন বছরের হিসাব শুরু করেন। আমাদের শিশু কিশোরদের কাছেও এই বাংলা নববর্ষ কম আনন্দের নয়। বরং এটি যেন তাদের এক প্রাণের উৎসব। গ্রামে শহরে সব জায়গায় বাঙালিরা তাদের প্রাণের বাংলা নববর্ষ বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় পালন করে। শিশুকিশোররাও নানা খেলায় মেতে নববর্ষের আনন্দে মেতে ওঠে। পৃথিবীর প্রত্যেক দেশে নববর্ষ পালনের রীতি আছে। ইংরেজি নববর্ষ পালনের নানা চিত্র পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমরা দেখতে পাই। আমাদের এ দেশটি হচ্ছে ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ। এদেশে বারোটি বাংলা মাস আছে, যেমনি আছে ইংরেজিতে বারোটি মাস। এদেশের বারোটি মাসের প্রতি দুমাসকে ঘিরে আছে একটি ঋতু। সেই এদেশে বিরাজমান ছয়টি ঋতু। প্রতিটি তার তার একেকটি বৈচিত্র্য নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। এমন ঋতু বৈচিত্র্যের অনিন্দ্য সুন্দর আরো কোথায়ও পরিদৃষ্ট হয় না। ঋতু বৈচিত্র্যের এমন রূপ লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছিলেন, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।’ এই বাংলা বারো মাসের প্রথম মাস বৈশাখ। এই বৈশাখ মাসের প্রথম দিনেই আমাদের প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ। ঋতুর প্রথম ঋতু গ্রীষ্ম। বাংলা নবর্বষের প্রধান আকর্ষণ বৈশাখী মেলা। এই মেলাকে ঘিরে পান্তা ভাতের উৎসবে মেতে ওঠে বাঙালিরা। মেলায় হরেক রকমের বাহারি জিনিস দেখে শিশুকিশোর ঐসব কিনতে মেলায় ঘুরে বেড়ায়। মাটির হরেক রকমের খেলনা, পুতুল নাচ, বায়োস্কোপ, সার্কাস, নাগরদোলার মত বাঙালির ঐতিহ্যমণ্ডিত জিনিসগুলো কার না হৃদয় ছুঁয়ে যায়? শিশুকিশোররা এ ঐতিহ্যমণ্ডিত খেলনাগুলোর স্পর্শ পেয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হয় এবং খুশি মনে বাড়ি ফেরে। ঢাকার রমনার বটমূলে বসে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। চট্টগ্রামের ডিসি হিলে ও শিরীষতলায়ও বসে বর্ষবরণ ও বৈশাখী মেলা। দেশের আরো বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য স্থানে নববর্ষকে কেন্দ্র করে এদেশের সব ধরনের মানুষ এ আনন্দে সামিল হয়। জারি, সারি, মুর্শীদি, মারফতি, ভাওয়াইয়া, কবিগান, পালাগান, দেশের গানে মুখরিত হয়ে বিভিন্ন অঞ্চল। এ যেন এক প্রাণের জোয়ার। নববর্ষকে কেন্দ্র করে করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা নামের বিশাল এক শোভাযাত্রা। দেশীয় ঐতিহ্যের নানা উপকরণের সমাহার ঘটে মঙ্গল শোভাযাত্রায়। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা ইতিমধ্যে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে মর্যাদা লাভ করেছে। পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে, আছে আবার বিভিন্ন জাতি। প্রত্যেক জাতির রয়েছে নিজস্ব সাহিত্য, সংস্কৃতির একটি ইতিহাস। এই সংস্কৃতির বিকাশ হয় ধীরে ধীরে। সময়, পথ পেরিয়ে হাজার বছরের ইতিহাসে তা দেশের মানুষের জীবন যাত্রার অংশ হয়ে দাঁড়ায় সময়ের পথ পরিক্রমায়। তাই প্রত্যেক জাতির কৃষ্টি, সংস্কৃতি তার হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত। ইংরেজদের, ফরাসিদের, জার্মানদের, আরবদের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। তারা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির আলোকে তাদের উৎসব উদযাপন করে। প্রত্যেক জাতির নিজস্ব কৃষ্টি সংস্কৃতি নিয়ে প্রত্যেকেই গর্ববোধ করে। আমাদের বাঙালির চিরায়িত সংস্কৃতি আমাদের অহংকার। দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যের একটি দিক আমাদের এই বাংলা নববর্ষ। বাংলার এই জনপদে তিল তিল করে গড়ে ওঠা এই সংস্কৃতি আমাদের অমূল্য সম্পদ। পৃথিবীর আর কোন দেশের সাথে আমাদের এই আবহমান এই কৃষ্টি সংস্কৃতির তুলনা মেলা ভার। ছোটবেলা থেকে এই সংস্কৃতি দেখে চর্চা করেই আমাদের বড় হয়ে ওঠা। পৃথিবীর যে কোনো দেশে যাই না কেন, যে কোনো প্রান্তেই থাকি না কেন বাঙালির উৎসবগুলো এলেই নিশ্চয়ই সবার মন দেশের এই উৎসবে একাকার হয়ে যায়। সেজন্য বিদেশে দেখি অনেকেই যেখানে বাঙালিরা আছে সেখানে বাংলা নববর্ষের মত উৎসবের আয়োজন করতে। যে সংস্কৃতির মধ্যে আমাদের বেড়ে ওঠা, যেখানে আমাদের শিকড় সেটা কখনো ভোলা যায় না। ভুলতে পারেননি যেমন মাইকেল মধুসুদন দত্তের মত বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী প্রতিভা। তিনি তাঁর জমিদারিত্ব ও অর্থ বিত্তের অহংকারে চেয়েছিলেন বাঙালিত্ব ছেড়ে ইংরেজ সংস্কৃতির লোক সাজতে। কিন্তু পারেননি। ফিরে এসেছিলেন শিকড়ের টানে। তাইতো শিকড়ের টানে তিনি তাঁর গ্রামের কপোতাক্ষ নদকে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে, সতত তোমারি কথা ভাবি এ বিরলে।’ বিদেশে বসে তাঁর এ লেখা আজো আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এই কপোতাক্ষ নদের দেশেই হাসন লালন বাউলদের জন্ম এবং এদেশেই আমরা পালন করি ঈদ, পূজা, প্রবারণা, বড়দিন কিংবা বাংলা নববর্ষের মত বাঙালির চিরকালীন শাশ্বত উৎসব। বাঙালিদের এই নববর্ষের সাথে আছে আমাদের শিকড়ের সম্পর্ক। এই শিকড়কে অস্বীকার করা মানে নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। বাঙালির বাংলা নববর্ষ আমাদের অহংকার। আমাদের অহংকারের এই শিকড়কে ধারণ করেই আমরা ফুলে-ফলে বিকশিত হতে চাই। শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪৩১।