শৈশবের চৌহদ্দি পেরিয়ে যখন কিশোরী পর্বের পালা শুরু, তখন থেকেই একটি নাম আমার চেনা হয়ে উঠলো। তিনি অন্ত্যমিলের বরপুত্র সকলের প্রিয় রাশেদ রউফ।
আজমিশালীর পাতায় অন্ত্যমিল পড়ে পড়ে কত কতবার মুগ্ধ হয়েছি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।তাঁকে কাছ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে পারাটা নিতান্তই সৌভাগ্যের বিষয়।
যাকে নিয়ে বলছি, তিনি সাগর সেঁচে মুক্তো আনেন। তাঁকে ঘিরেই
তাঁর ষাট বছর পূর্তিতে খুবই আনন্দঘন একটা অনুষ্ঠান উপভোগ করলাম বছরের প্রথম দিন। চট্টগ্রাম একাডেমির ফয়েজ নূরনাহার মিলনায়তন যেন ভাসছিলো ফুলেল শুভেচ্ছার অথৈ সাগরে।
খুব সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠান হলেও লোকসমাগম মাত্রাতিরিক্ত হবে এটা সহজেই অনুমেয়। এতে অবাক হবার কিছুই নেই। তাঁকে শ্রদ্ধা করেন না, ভালোবাসেন না এমনটা হতেই পারে না। একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা তাঁর জন্য অবধারিতভাবে তোলা আছে, তাতে নিত্যদিন নতুন নতুন সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ভাবতেই ভালো লাগে।অনুষ্ঠান শুরুর প্রথমদিকেই দর্শকসারি একদম পরিপূর্ণ।
যেখানে আমার বসার ঠাঁই হলো তার পাশেরজন পরিচয় পর্ব শেষে
বললেন,”রাশেদ রউফ সকলের এত প্রিয় কেনো জানেন?”
‘তিনি সদা হাস্যোজ্জ্বল একজন মানুষ। আর শতভাগ অসাম্প্রদায়িক। এটাই তাঁর জনপ্রিয়তার নেপথ্যে এক উল্লেখযোগ্য কারণ।’
আমি তাঁর চোখে স্যারের জন্য এক পবিত্র ভালোবাসা দেখতে পেলাম।
এমন অসাম্প্রদায়িক চেতনা এ সময়ে সত্যিই বিরল।
সেদিন বিভিন্নভাবে বিশিষ্টজনেরা তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন কথা বলেছেন সংক্ষিপ্ত পরিসরে।
প্রত্যেকের কথায় তাঁর জন্য একটি কথাই বারবার উচ্চারিত হয়েছে নানা ভাবে, সেটা হলো “রাশেদ রউফের তুলনা তিনি নিজেই”।
বছরের প্রথমদিন সন্ধ্যায় প্রায় তিনঘণ্টার এই অনুষ্ঠানে প্রত্যেকে চেয়েছিলেন কিছুটা সময়ের জন্য হলেও প্রিয় মানুষটিকে একবার শুভেচ্ছা জানাতে।তাই অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত শুভাকাঙ্ক্ষীদের আসা অব্যাহত ছিলো বলা যায়।

গান, আবৃত্তি, বিভিন্ন লেখা পাঠের মধ্য দিয়ে উপস্থিত সকলে প্রিয় মানুষটিকে শুভেচ্ছায় সিক্ত করেন। উপস্থিত একজন অতিথির গানে উচ্ছ্বসিত হয়ে বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী কবিপত্নী আয়েশা হক শিমু ম্যাম আর অধ্যাপক ববি বড়ুয়া ম্যামের অনবদ্য একটি নাচ এক অনন্যমাত্রা যোগ করেছে অনুষ্ঠানে।
বিভিন্ন সংগঠন থেকে তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা ও জানানো হয়। চট্টগ্রাম একাডেমি, বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি, অনন্যধারা, উইম্যান চেম্বারস অব কমার্স, শিল্পশৈলী, কিশোরবেলা, ছড়া শৈলী, লেখক শৈলী, রাদিয়া প্রকাশন, আজাদীর বিভিন্ন স্তরের সংশ্লিষ্টরা তাঁকে ফুলের শুভেচ্ছা জানান।
এরপর গতানুগতিক নিয়মে কেক কেটে অনুষ্ঠানের মূল পর্বের সূচনা হয়।
এ পর্যায়ে শিমু ম্যাম তাঁকে তাঁর অভিব্যক্তি জানানোর জন্য মাইক্রোফোন হাতে তুলে দেন।
তিনি যখন তাঁর কথামালা শুরু করলেন, তখন মিলনায়তনে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে।
তিনি সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করলেন তাঁর বক্তব্য।
সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনছেন, অনুভব করতে চাইছেন।
তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় ভাগ করে নিলেন সবার সাথে। তিনি জানালেন আজাদীর সাথে তাঁর পথচলার কথা। দীর্ঘ তেত্রিশটি বছর তিনি এই পত্রিকার সাথে আছেন। তিনি তাঁর সততা, বিচক্ষণতা, অভিজ্ঞতায় মধ্যমণি হয়ে উঠেছেন এই পত্রিকাটির। এই দৈনিক থেকে তাঁকে দু’বার সম্মাননা প্রদান করা হয়। এটি নিঃসন্দেহে একটি পরম পাওয়া।
তাঁর কথায় জানা গেলো, তিনিই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের প্রথম ছাত্র, যিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০১৬) লাভ করেন।
পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে অনেকেই এই পুরস্কার পেয়েছেন।
তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে আলোকপাত করে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর চেয়ে কম বয়সে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দেন।
সে তুলনায় তিনি এখনো তেমন কিছুই করতে পারেন নি।
তাঁর অনেককিছুই করার বাকি এখনো। আর এসব কিছুর জন্য তাঁকে বেঁচে থাকতে হবে আরও অনেকদিন।
তিনি সুস্থভাবে আরও অনেকদিন বাঁচতে চান।
আমি যদি খুব বেশি ভুল করে না থাকি, তবে এটাই সত্যি যে এই সময় তিনি খুব আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েন খানিকের জন্য।
গলার স্বর যেনো ধরে এলো।
ব্যক্তিগতজীবনে তিনি খুব দৃঢ় চরিত্রের মানুষ বলে তিনি দাবি করেন। তিনি কর্মজীবনে সততা আর নিষ্ঠার সাথে কাজ করে গেছেন। অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি কখনো।
অনুষ্ঠানের একেবারে শেষের দিকে সবাইকে আবেগে আপ্লুত করেছেন মেয়ে আয়মান রউফ আর শিমু ম্যামের কথামালায়। আবেগে উপস্থিত সবার চোখের কোণে নেমে এলো অশ্রুবিন্দু। এক মুহূর্তের জন্য সবাই যেনো নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে স্যারের প্রতি ভালোবাসায় উৎসর্গীত।
তাঁর ষাট বছর পূর্তিতে জন্মদিনের এই অনুষ্ঠানকে স্মরণীয় করে রাখতে তাঁকে নিয়ে একটি সম্মাননা গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়,”মঙ্গলালোকে রাশেদ রউফ ” শিরোনামে। এটি সম্পাদনা করেন নিজামুল ইসলাম সরফী।
নামমাত্র মূল্যে উপস্থিত সকলে এটি সংগ্রহ করে নেন।
বিশিষ্টজনেরা এতে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে রাশেদ রউফকে নিয়ে তাঁদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বইটিকে একটি অনন্য মাত্রায় নিয়ে যান।
সম্প্রতি প্রতিবেশি দেশ ভারতে তাঁর কবিতা নিয়ে পনেরো ডিসেম্বর দু’হাজার তেইশে উদযাপিত হয় বাংলাদেশের বিজয় দিবস।
এটি সমগ্র বাংলাদেশ তথা চট্টগ্রামের জন্য বিরাট একটা সম্মান বয়ে এনেছে নিঃসন্দেহে।
নতুনদের লেখাকে গুরুত্ব দিয়ে, তাঁদের লেখা ছাপার হরফে পত্রিকার পাতায় ফুটিয়ে তোলার জন্য চট্টগ্রামের প্রতিটা নতুন লেখক তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ।
নতুনদের সহজে কেউ গুরুত্ব দিতে চায়না, সেক্ষেত্রে তিনি বাতিঘর হয়ে কাজ করছেন। দিকনির্দেশনা দেন, কোনটাতে ভালো, কোনটাতে খারাপ। স্নেহের ছায়ায় রাখেন, নতুনদের। এটা নতুনদের জন্য একটি পরম পাওয়া।
এমন একজন বিদগ্ধজনের জন্মদিনের শুভ মুহূর্তে উপস্থিত থাকতে পারাটা অবিশ্বাস্য রকমের বাড়তি পাওয়া বলে মনে হলো আমার।
পরমকরুণাময় তাঁর সৃষ্টিশীল দীর্ঘ জীবন দান করুন। লেখক : প্রাবন্ধিক, আবৃত্তিশিল্পী