১.
শামসুর রাহমান জন্মেছিলেন ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর সকালে ঢাকার মাহূতটুলিতে। আর মৃত্যুবরণ করেন ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট সন্ধ্যায়। এই আটাত্তর বছরে শামসুর রাহমান হয়ে উঠেছেন জাতির প্রিয় কবি। আঠার বছর বয়সে লেখালেখি শুরু করেছিলেন তিনি। তাই বলা যায়, ৬০ বছর ধরে মূলত কাব্যসাধনার মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠ নির্মাতা হয়ে উঠেছেন। বিষয়ে, আঙ্গিকে, উপস্থাপনায় তাঁর কবিতা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। দুর্বোধ্যতার সমস্ত কাঁটাতার ছিন্ন করে তিনি পৌঁছে গেছেন সকল শ্রেণীর পাঠকের কাছে। হয়ে উঠেছেন গ্রহণীয় ও প্রিয়। উভয় বাংলায় তিনি জনপ্রিয়। তাঁর স্বীকৃতি সমগ্র বাংলা জুড়ে। সমান আদৃত তিনি।
শামসুর রাহমান নির্মাণ করেছেন বহু অসামান্য কবিতা। দেশকে নিয়ে, দেশের মানুষকে নিয়ে, স্বাধীনতাকে, মাতৃভাষাকে নিয়ে তাঁর রচিত কবিতাগুলো আজ ইতিহাস হয়ে আছে। বায়ান্নর প্রেক্ষাপটে লেখা ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, একাত্তরে লেখা তাঁর অসাধারণ কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ কিংবা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, এর আগে লেখা ‘সফেদ পাঞ্জাবি’ কিংবা ‘আসাদের শার্ট’ কবিতায় ভেসে উঠেছে জাতির স্বপ্ন ও কণ্ঠস্বর। শামসুর রাহমানের এ ধরনের কবিতা ক্রমশ দেশ ও জাতির আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠে। আশা, স্বপ্ন আর ভালোবাসার পাশাপাশি অন্যায়-অত্যাচার-জুলুম-অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি ক্ষোভ সঞ্চার করেছেন তাঁর কবিতায়। শুভবোধ ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি নিরন্তর লড়ে গেছেন। ফলে তিনি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন জাতির কণ্ঠস্বর, হয়ে উঠেছেন জাতীয় ইতিহাসের অনন্য ভাষ্যকার। তিনি আজ নেই কিন্তু আছে তাঁর সৃষ্টি সম্ভার-যেগুলো আমাদের আলোকিত করবে নিরন্তর, স্বপ্ন দেখাবে, পথ দেখাবে সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের।
২.
শামসুর রাহমানের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। পরিচয় কিংবা ঘনিষ্টতা বাড়ে জাতীয় কবিতা উৎসবকে কেন্দ্র করে। আমার সম্পাদিত লিটন ম্যাগ ‘প্রেরণা’র একটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল জাতীয় কবিতা উৎসব ’৮৮ উপলক্ষে। ঐ সংখ্যার জন্য তাঁর একটি কবিতা পাঠানোর সাথে সাথে আরও বেশ ক’জন কবির লেখা সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁদের মধ্যে ছিলেন নির্মলেন্দু গুণ, মুহম্মদ নুরুল হুদা, মোহন রায়হান প্রমুখ। মারুফ রায়হানের একটি কবিতা আলাদাভাবে পাঠালেন। সংখ্যাটি প্রকাশিত হওয়ার পর বেশ প্রশংসিত হয়। সেই থেকে চট্টগ্রামে অবস্থান করেও এই বটবৃক্ষের সাথে আমি নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেছি। আমার সমস্ত প্রকাশনা তাঁর কাছে পাঠাতাম।
৩.
শামসুর রাহমানের একটি অনবদ্য কবিতা ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক ইত্তেফাকে। এর পর ‘যায়যায়দিন’-এ ‘কবির লড়াই’ শিরোনোমে শামসুর রাহমানের কবিতার জবাব দেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। এটি তৎসময়ে বেশ আলোড়ন তোলে। আলোচনার ঝড় তোলে। পরে ‘শামসুর রহমানের কবিতা ও একটি মোনাজাতের খসড়া’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ আমি লিখি দৈনিক পূর্বকোণের সাহিত্যের পাতায়। লেখাটি ছাপা হওয়ার পর শামসুর রাহমানের বাড়তি স্নেহ আমি লাভ করি।
এরপর দৈনিক আজাদীতে ৬ নভেম্বর ১৯৯৩-এ ‘কবিতার দেশের রাজপুত্তুর’, ২৩ অক্টোবর ১৯৯৭ এ ‘৬৯তম জন্মদিনে’, অক্টোবর ১৯৯৮ সালে ছোটদের কাগজ দুরন্ত-এ ‘শামসুর রাহমানের ছড়াসাহিত্য’ এবং ২৭ অক্টোবর ২০০০-এ দৈনিক পূর্বকোণে ‘শামসুর রাহমান ও তাঁর ছড়া’, আগস্ট ২০০২-এ গাঙচিলে ‘শামসুর রাহমানের ছড়াসাহিত্য’ প্রভৃতি প্রবন্ধ লিখে তাঁর অকৃত্রিম সান্নিধ্য আমি অর্জন করি। এ ছাড়া ১৯৯৫ সালে ‘দুরন্ত’ শিরোনামে আমার একটি সম্পাদিত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এতে দশ ক্ষেত্রে বিখ্যাত দশ ব্যক্তিত্বকে মূল্যায়ন করা হয়। শামসুর রাহমানকে নিয়ে লিখেছিলাম আমি নিজেই।
৪.
কবি শামসুর রাহমান ছিলেন আমার লেখালেখি জীবনের অন্যতম পথপ্রদর্শক। দূরে থেকেও তাঁর লেখাকে আমি বোঝার চেষ্টা করেছি। শুধু কবিতা নয়, অন্যান্য রচনারও ছিলাম আমি মুগ্ধ পাঠক। কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি, তিনি ঈদ সংখ্যা বিচিত্রায় ও পরবর্তীকালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘মূলধারায়’ আমার একাধিক কবিতা ছেপে আমাকে ধন্য ও কৃতার্থ করেছেন।
১৯৮৯ সালে ‘আমি জীবনানন্দ -তুমি বনলতা সেন’ নামে আমার একটি কবিতা তাঁকে দেখাই। তিনি সেটার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং এটি ভালো একটি পত্রিকায় পাঠাতে বলেন। আমি এটি পাঠিয়ে দিই হেনা স্যারের কাছে। আমার সৌভাগ্য, বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘উত্তরাধিকার’-এ এটি গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়। আজ এই পরিসরে শামসুর রাহমানের সাথে সাথে ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের প্রতিও আমি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
কবি শামসুর রাহমানের কাছে আরও বেশি কৃতজ্ঞ এ কারণে যে, ১৯৯৯ সালে আমার ‘স্বাধীনতার প্রিয় কবিতা’ গ্রন্থের ছোট্ট একটি ভূমিকা তিনি লিখে দিয়েছিলেন। তিনি লিখলেন : বাংলা সাহিত্যে এখন কিশোর কবিতার জোয়ার বইছে। আর এই কাব্য জোয়ারের অন্যতম এক তরুণ কারিগর রাশেদ রউফ। তিনি কিশোর কবিতার চিরন্তন ধারাকে আগলে রেখে তাকে আধুনিকতম করার লক্ষ্যে পালন করছেন অনন্য ভূমিকা। বিষয়-বৈচিত্র্য, চিত্রকল্প, শব্দ-কুশলতা এবং ছন্দ-নৈপুণ্যে রাশেদ রউফের কবিতা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। তাঁর কবিতায় যেমন উঠে এসেছে কিশোর মনের চাওয়া-পাওয়া, দুরন্তপনা, আবেগ,উচ্ছ্বাস, অভিমান; তেমনি তাদের রহস্যময়তাও পেয়েছে ছন্দোময় রূপ। তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দেশপ্রেম। গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, দেশ এবং দেশের মানুষ চমৎকার অনুষঙ্গ হয়ে সৃষ্টি করেছে বাড়তি ব্যঞ্জনা। প্রতিটি কবিতার শরীরে ও মর্মে নৈসর্গিক কাব্যধারা সবেগে প্রবহমান। ছন্দ-স্বতঃস্ফূর্ততাও এই কবিতাগুলোর অন্যতম আকর্ষণীয় দিক। শিশুসাহিত্যের সোনালি যুগ ছিল শুধু শিশুদের। আর আধুনিক যুগ ছোট বড় সকলের। কাজেই এই বইটিও ছোটদের পাশাপাশি বড়দের আবেগকে উজ্জীবিত করবে। আমি রাশেদ রউফের কাব্যকর্ম-জীবনের দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
কবি শামসুর রাহমানের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে আমি অগ্রসর হচ্ছি। আমার লেখায় ও পথ চলায় তিনি আছেন বড় এক প্রেরণাদাতা হয়ে, তিনি আছেন শক্তি হয়ে। পরিশেষে ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে যে কবিতাটি আমি লিখেছিলাম, সেটি এখানে উপস্থাপন করে আমার এ ছোট্ট লেখার সমাপ্তি টানতে চাই।
ঘুমাও প্রিয় কবি, ঘুমাও ভালোবাসা
রাশেদ রউফ
ওড়ে না প্রজাপতি ভুলেছে সুর-গতি
মনের বনে বনে নেমেছে দুর্গতি!
থমকে আছে ওই আকাশে কালো মেঘ
বাতাস ভারি হয় ছড়ায় উদ্বেগ!
থেমেছে কলরব অন্য অনুভব
এখানে নিঃসীম নীলিমা কী নীরব!
মাথায় করে ভর স্মৃতির রাঙা খড়
রেখেছি লিখে আমি সোনালি অক্ষর।
যে তুমি পাখি ছিলে যে তুমি ছিলে ফুল
যে তুমি ঢেউ ছিলে-অচেনা নদী-কূল।
সেজেছো প্রজাপতি কখনো ভীমরুল
ওড়ালে মন-রথ, ওড়ালে সাদা চুল।
তুমি তো উড়িয়েছো পতাকা পত্ পত্
দেখালে আলোকিত স্বপ্নে ঘেরা পথ।
হারালো সব সুখ লুকালে প্রিয় মুখ
এখন তুমি নেই, পাথরে বাঁধি বুক।
তোমারই সম্মান ছুঁয়েছে আসমান
তোমাকে নিয়ে হয় কবিতা-ছড়া-গান।
তোমারই সব কথা পেয়েছে স্বাধীনতা
তুমিই পেলে আজ স্বর্গ-অমরতা।
মায়ের কোলে-বুকে আদরে আর সুখে
ঘুমাও প্রিয় কবি, শান্তি চোখে-মুখে।
ঘুমায় বাড়ি-ঘর ঘুমায় চরাচর
ঘুমাও ভালোবাসা, ঘুমাও সুন্দর।